প্রাচীন কালে ভারতে মৌর্য এবং ইউরােপে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য খ্যাতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল। মৌর্ষ সাম্রাজ্যের পূর্বে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটলেও উভয় সাম্রাজ্য অন্তত কিছুকাল সমসাময়িক ছিল। স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন বিষয়ে উভয় সাম্রাজ্যের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের আলােচনাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হয়।

মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে যেসব বিষয়ে সাদৃশ্য লক্ষ করা গিয়েছিল সেগুলি হল—

মৌর্য সাম্রাজ্য

  • সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নিজের কৃতিত্বে মগধের রাজ্যসীমা বহুদূর বিস্তৃত করেন। সমগ্র উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বৃহদংশ জুড়ে তার সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়। তাঁর সাম্রাজ্যে চারটি প্রদেশ ছিল। যেমন- (i) উত্তরাপথ, (ii) অবস্তী, (iii) দক্ষিপাপথ ও (iv) প্রাচ্য। সম্রাট অশােক কলিঙ্গ দখল করলে তা সাম্রাজ্যের পঞ্চম প্রদেশে পরিণত হয়।

  • মৌর্য শাসনব্যবস্থায় বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পর বিভিন্ন শাসক বংশানুক্রমে মগধের রাজসিংহাসনে বসেন।

  • মৌর্য শাসনব্যবস্থা ছিল বিকেন্দ্রীভূত। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য দেশের সামরিক, বিচার ও রাজস্ব ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। রাষ্ট্র পরিচালনার উদ্দেশ্যে তিনি মন্ত্রীমণ্ডলী, অধ্যক্ষ, বলাধ্যক্ষ, নগরাধ্যক্ষ প্রভৃতি কর্মচারী নিয়ােগ করতেন।

  • মৌর্যবংশের শাসনকালে শিল্পকলার অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছিল। এযুগে বিভিন্ন প্রাসাদ, স্থূপ, স্তম্ভ, গুহা প্রভৃতি নির্মিত হয়েছিল। সাঁচি, সারনাথ, কুমারহার, এলাহাবাদ, নন্দনগড়, বুশ্মিনদেই প্রভৃতি স্থানে মৌর্য শিল্পকলা ছড়িয়ে আছে।

  • মৌর্য সাম্রাজ্যে জ্ঞানবিজ্ঞানের যথেষ্ট চর্চা হত। এযুগে সাহিত্য, ছন্দ, ব্যাকরণ, চিকিৎসাবিদ্যা প্রভৃতির অগ্রগতি ঘটেছিল। এযুগে উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে উজ্জয়িনী, তক্ষশীলা, বারাণসী, পাল প্রভৃতি স্থানের সুখ্যাতি বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য

  • আলেকজান্ডারের আমলে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য ইউরােপ, উত্তর আফ্রিকা এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশ পর্যন্ত বৃহৎ ভূখণ্ডে প্রসারিত হয়েছিল। তার সাম্রাজ্য তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য বলে পরিগণিত হয়।

  • ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যেও বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিভিন্ন শাসক উত্তরাধিকারসূত্রে ম্যাসিডনের রাজসিংহাসনে বসেছিলেন।

  • শাসনের সুবিধার্থে ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত ছিল। শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থানকারী সম্রাট ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান, ধর্ম- ব্যবস্থার প্রধান এবং বৈদেশিক সম্পর্কের প্রধান নীতি-নির্ধারক।

  • ম্যাসিডনীয় শাসনকালেও শিল্পকলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছিল। সম্রাট আলেকজান্ডার ৭০ টি নতুন শহর নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। তার আমলে বহু রাস্তাঘাট, বন্দর প্রভৃতিও নির্মিত হয়।

  • ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যেও জ্ঞানবিজ্ঞানের যথেষ্ট চর্চা হত। জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়া ছিল সেযুগের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। ইউক্লিড, এরাটোথেনিস, আর্কিমিডিস, হিপার্কাস, হিরাে প্রমুখ বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ এযুগেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

মৌর্য ও ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে যেসব বিষয়ে বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা গিয়েছিল সেগুলি হল-

মৌর্য সাম্রাজ্য

  • মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ১৩ থেকে ১৪০ বছর (৩২৪-১৮৭/১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। অর্থাৎ ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের তুলনায় মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ছিল অনেক কম।

  • মৌর্য সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি প্রধানত ভারতে সীমাবদ্ধ ছিল। ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের আয়তনের তুলনায়। মৌর্য সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল অনেক কম।

  • ভারতের সুবিস্তৃত অঞ্চলে মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমানা প্রসারিত হয়েছিল। সম্রাট অশােকের উদ্যোগেও ভারত এবং ভারতের বাইরে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটেছিল। কিন্তু একথা কখনােই বলা যায় না যে, বিশ্বের বিশাল একটি ভূখণ্ডে মৌর্য সংস্কৃতির প্রসার ঘটেছিল।

  • মৌর্য যুগের শিল্পকলায় সামান্য বৈদেশিক প্রভাব পড়লেও এযুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ছিল বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত। বৈদেশিক সংস্কৃতির সঙ্গে মৌর্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণের বিশেষ কোনাে সুযােগ ঘটেনি।

  • সম্রাট অশােকের উদ্যোগে বৌদ্ধধর্ম ভারতের সীমানা অতিক্রম করে সুদূর চিন, সিংহল, সিরিয়া, মিশর, কাইরেনি, ম্যাসিডন, এপিরাস, আফগানিস্তান সহ দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল।

ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য

  • ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ছিল অন্তত ৬৬২ বছর (৮০৮-১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। অর্থাৎ মৌর্য সাম্রাজ্যের তুলনায় ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ছিল অনেক বেশি।

  • ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য গ্রিক ভূখন্ড অতিক্রম করে ইউরােপের আরও বেশ কিছু অঞ্চল, পারস্য, উত্তর আফ্রিকা, এমনকি ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।

  • আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য দীর্ঘস্থায়ী না হলেও তার দিগ্‌বিজয়ের ফলে গ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতি বহুদূর প্রসারিত হয়েছিল। মিশরে গ্রিক ভাষার এতটাই প্রসার ঘটেছিল যে, ইহুদিরা তাদের ধর্মগ্রন্থ ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’ গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করতে বাধ্য হয়েছিল।

  • ম্যাসিডনীয় সম্রাট তৃতীয় আলেকজান্ডারের দিগ্‌বিজয়ের ফলে গ্রিসের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের যােগসূত্র গড়ে উঠেছিল এবং এর ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ ঘটেছিল।

  • ধর্মপ্রচারের বিষয়ে কোনাে ম্যাসিডনীয় সম্রাট মৌর্য সম্রাট অশােকের মতাে বিশেষ উদ্যোগ নেননি। ফলে ম্যাসিডনীয় সম্রাটদের নিজস্ব ধর্মমত দেশের সীমানা অতিক্রম করে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েনি।