সূচনা: সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি বা চরিত্র নিয়ে আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ধর্মীয় দিক থেকে সুলতানি রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী না ধর্মনিরপেক্ষ ছিল শাসনতান্ত্রিক বিচারে সুলতানি রাষ্ট্র সামরিক না অভিজাততান্ত্রিক ছিল তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।
[1] ধর্মীয় দিক থেকে
-
প্রবক্তাগণ: সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতিকে যে সমস্ত ঐতিহাসিক ধর্মাশ্রয়ী (Theocratic) বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন—ড. আর. পি. ত্রিপাঠী, ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ, ড. শ্রীবাস্তব, ড. রামশরণ শর্মা, ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ।
-
ধর্মাশ্রয়ী রাজাদর্শ: দিল্লির সুলতানরা ছিলেন একাধারে রাষ্ট্র ও ধর্মনেতা। ইসলামের বিধি মেনেই দিল্লির সুলতানগণ শাসনকাজ চালাতেন। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ‘দার উল-হার্ব’ (অমুসলমানের দেশ)-কে ‘দার-উল ইসলাম (মুসলমানের দেশ)-এ পরিণত করা।
-
খলিফার অনুমােদন: খলিফা ছিলেন সমস্ত মুসলিম দুনিয়ার প্রধান ধর্মগুরু এবং শাসক। তাই প্রথমদিকের কয়েকজন সুলতান তাদের মুদ্রায় খলিফার নাম উৎকীর্ণ করান এবং খলিফার নামে খুৎবা পাঠ করান।
-
উলেমাদের ওপর নির্ভরশীলতা: সুলতানি আমলে উলেমারা ছিলেন কোরান ও শরিয়তের ব্যাখ্যাকার। তাঁরা প্রয়ােজনে সুলতানকে ধর্মীয় ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন। আলাউদ্দিন খলজি ছাড়া অন্যসব সুলতানের আমলেই উলেমাদের যথেষ্ট প্রভাব ও প্রতিপত্তি বজায় ছিল।
-
অমুসলমানদের অধিকারহীনতা: সুলতানি রাষ্ট্রে অমুসলমান শ্রেণির তেমন কোনাে অধিকার ছিল না। জিজিয়া কর প্রদানের বিনিময়ে সুলতানি রাষ্ট্রে বসবাস করা ছাড়া তারা আর কোনাে বিশেষ সুযােগসুবিধা ভােগের অধিকারী ছিলেন না।
-
প্রবক্তাগণ: একদল আধুনিক ঐতিহাসিক মনে করেন সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। এই মতের কয়েকজন প্রবক্তা হলেন—ড, হাবিবউল্লাহ, ড. মুজিব, ড. মহম্মদ হাবিব, ড. ইফতিকার আলম খান, ড. নিজামি, ড. সতীশ চন্দ্র প্রমুখ।
-
ধর্মনিরপেক্ষ রাজাদর্শ: ড. হাবিবউল্লাহ মনে করেন সুলতানি রাষ্ট্র ধর্মাশ্রয়ী ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষতাই ছিল এর মূলভিত্তি। তার মতে দিল্লির সুলতানগণ রাষ্ট্রকে ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘােষণা করেননি। সুলতানগণ অমুসলমানদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্যেও কোনাে রাষ্ট্রীয় নীতি গ্রহণ করেননি৷
-
শরিয়ত থেকে বিচ্যুতি: দিল্লির সুলতানগণ শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বদা শরিয়ত নির্দেশিত বিধি মেনে চলেননি। ইসলামের বিধান অনুযায়ী মুসলিমদের প্রাণদণ্ড নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ফিরােজ তুঘলক ছাড়া অন্য কোনাে সুলতানের আমলে তা মানা হয়নি। শরিয়ত বিধি অনুসারে ইসলামীয় রাষ্ট্রে পৌত্তলিকদের কোনাে জায়গা নেই। কিন্তু সুলতানি শাসনে ভারতে হিন্দু পৌত্তলিকদের অস্তিত্ব ছিল।
-
খলিফার কর্তৃত্ব অস্বীকার: দিল্লির সুলতানগণ বাস্তবে খলিফার নির্দেশ মেনে শাসন পরিচালনা করতেন না। চেঙ্গিজ খাঁর পৌত্র হলাগু-র হাতে আব্বাসীয় খলিফা আল-মুস্তাসিন বিল্লাহ নিহত হলে দিল্লির সুলতানদের কাছে খলিফার অনুমােদন লাভ ঐচ্ছিক হয়ে পড়ে।
-
উলেমাদের ক্ষমতা হ্রাস: সুলতানি রাষ্ট্রে মুসলিম ধর্মবিশারদ উলেমারা রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় ব্যাপারে সুলতানদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু সুলতানরা উলেমাদের কথামতাে দেশশাসন বা ধর্মনীতি প্রণয়ন করতেন না।
[2] রাষ্ট্রীয় দিক থেকে
-
সামরিক: সুলতানি রাষ্ট্র সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছিল। এর স্থায়িত্বও সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল ছিল। কেউ কেউ মনে করেন সুলতানি রাষ্ট্র ছিল প্রকৃত অর্থে একটি পুলিশ-রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য ছিল—দেশরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং রাজস্ব আদায় করা।
-
অভিজাততান্ত্রিক: কারাে কারাে মতে সুলতানি শাসন ছিল একটি কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্র। এই রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অভিজাতদের বিশেষ স্থান ছিল। সুলতান ইলতুৎমিস ‘বন্দেগান ই-চাহেলগানি নামক অভিজাত তুর্কিগােষ্ঠীর হাতে প্রভূত ক্ষমতা দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে অতুর্কিরাও অভিজাততন্ত্রে স্থান পেয়েছিল।
মূল্যায়ন: সার্বিক বিচারে সুলতানি রাষ্ট্রকে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলা চলে না। কেননা সমন্বয়বাদী সুলতানি শাসনব্যবস্থায় একদিকে যেমন খলিফাতন্ত্র উপেক্ষিত হয়েছিল অপরদিকে উলেমাদের প্রভাব নগণ্য হয়ে পড়েছিল। ড., সতীশ চন্দ্র বলেছেন, “প্রকৃতপক্ষে সুলতানি রাষ্ট্র ছিল সামরিক ও অভিজাততান্ত্রিক।”
Leave a comment