সূচনা: রােমান রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন মার্ক তুল্লি সিসেরাে (১০৬-৪৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। তিনি পূর্বপ্রচলিত রোমান রাষ্ট্রব্যবস্থার যাবতীয় প্রথারীতি নীতিকে সংশােধনের উদ্যোগ নেন এবং রোমান আইনতত্বকে বিশ্বজনীনতার আদর্শে উত্তরণ ঘটান।

[1] উৎস: প্লেটো, অ্যারিস্টটল, পলিবিয়াস এবং স্টইকদের মতবাদ সিসেরাের রাষ্ট্রচিন্তাকে সব থেকে বেশি প্রভাবিত করে। পাশাপাশি সমকালীন রােমের সমাজজীবন এবং রাজনীতির গতিপ্রকৃতি তার রাষ্ট্রচিন্তার মূল উৎস ছিল।

[2] সরকার: সিসেরাে রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্র এই তিন ধরনের সরকারের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন— একজনের শাসন হল রাজতন্ত্র, কয়েকজনের শাসন হল প্রজাতন্ত্র, বহুজনের বা সমাজের সকলের শাসন হল গণতন্ত্র। এই তিন ধরনের সরকারের গুণাবলির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মিশ্র সরকার হল সর্বোৎকৃষ্ট।

[3] আইনগত ধারণা

  • মূল বক্তব্যসমূহ: (a) সিসেরাের মতে, আইন মানবিক চিন্তার ফসল নয়, তা হল শাশ্বত, সনাতন। (b) বাস্তব নীতির ওপর গড়ে ওঠে আইন, যা সমগ্র বিশ্বকে চালনা করে। (c) আইন হল ঈশ্বরের প্রাথমিক ও চূড়ান্ত ইচ্ছা, যা যুক্তি দিয়ে বাধা ও বাধ্যতার দ্বারা সমস্ত কিছুকে পরিচালিত করে। (d) সিসেরাের ধারণায় পশুজগৎ আইনের তাৎপর্য বােঝে না, কিন্তু তারাও সহজাত প্রকৃতি গুণে আইন মেনে চলে। (e) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষই কেবলমাত্র তার চিন্তা শক্তির দ্বারা আইনের প্রয়োজনীয়তা বা তাৎপর্য বুঝতে পারে।

  • প্রাকৃত আইন: সিসেরাের ধারণায় প্রাকৃত আইন ভগবানের তৈরি, তাই একে লঙ্ঘন করা যায় না। বিশ্বের সর্বত্র এই প্রাকৃত আইনের অস্তিত্ব রয়েছে।

[4] ন্যায়বিচার: সিসেরাের ধারণায় প্রাকৃত আইনের যথার্থ প্রয়ােগ ঘটলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হতে পারে। সিসেরাের ধারপায় রাষ্ট্রের সমস্ত আইন ও সমাজের সমস্ত প্রথা যখন যুক্তিবাদী আইন দ্বারা পরিচালিত হবে, তখন সমাজে ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা ঘটবে।

[5] প্রাকৃতিক সাম্য: সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি জুড়ে প্রাকৃতিক সাম্যের অস্তিত্ব বিদ্যমান। সমতার নীতি মেনেই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রজীবন পরিচালিত হয়। সিসেরাে প্রাকৃত সাম্যনীতির সাহায্যে ক্রীতদাস-সহ সমাজের সমস্ত শ্রেণির মানুষকে সমান সুযােগসুবিধাদানের পক্ষপাতী ছিলেন।

সমালােচনা: সিসেরাের রাষ্ট্রচিন্তা পরবর্তীকালে বিভিন্ন দার্শনিকের কাছে সমালােচিত হয়েছে। গেটেল বলেছেন— সিসেরাের রাষ্ট্রতত্বে তেমন কোনাে মৌলিকতা ছিল না। সমালােচকদের মতে—সিসেরাে উদ্ভাবনশীল চিন্তাবিদ ছিলেন না। সিসেরাের আইনি ভাবনাও মৌলিক ছিল না, তা ছিল গ্রিক ও নির্বিকারবাদী ধারণার অনুসারী।

[1] বিশ্বসমাজ গঠন: সিসেরাের রাষ্ট্রাদর্শের ধারণা মেলে তার দুই রাজনৈতিক গ্রন্থ ‘দ্য রিপাবলিক’ (The Republic) এবং ‘দ্য লজ’ (The Laws) থেকে। সিসেরাে এই বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রকে নিয়ে একটি আদর্শ রাষ্ট্রসমবায় বা কমনওয়েলথ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।

[2] উৎপত্তির কারণ: সিসেরাের ধারণায় ব্যক্তির স্বাভাবিক সামাজিক প্রবণতা এবং তাদের সম্মিলিত ইচ্ছার কারণেই রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। সিসেরাে মনে করতেন কোনাে আবেগ বা স্বার্থ নয়, সাধারণ যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়েই বিবর্তনের পথ ধরে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে।

[3] রাষ্ট্রত্ত্বের মূলকথা: সিসেরাের রাষ্ট্রত্বের মূল কথা হল—[i] রাষ্ট্র এমন এক নৈতিক সংস্থা যা কিছু ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে গড়ে উঠেছে। [ii] রাষ্ট্র হল আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি সামাজিক সংগঠন যা বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণে নিয়ােজিত। [iii] রাষ্ট্র একদিকে আইনি সংস্থা অপরদিকে ন্যায়ের প্রতীক। তাই শাসক ও শাসিত উভয়ই রাষ্ট্রকে মেনে চলতে বাধ্য। [iv] রাষ্ট্র একটি যৌথ সংস্থা। প্রতিটি নাগরিকই এর সদস্য।

মূল্যায়ন: পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার প্রাচীন ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে প্লেটো ও অ্যারিস্টটুলের পরেই সিসেরাের স্থান। বিশ্বজনীন আদর্শের প্রেক্ষাপটে বিশ্বসমাজ (Commonwealth) বা রাষ্ট্র সমবায় (Confederation) গঠনের তত্ত্ব রাষ্ট্রচিন্তার জগতে এক নবদিগন্তের উন্মােচন ঘটায়।