সূচনা: রাষ্ট্রচিন্তার জগতে এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব হলেন ফরাসি চিন্তাবিদ জঁ-জাক রুসো রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে রুশাের স্থান নির্ণয় করতে গিয়ে অধ্যাপক হানশ বলেছেন- “রাজনৈতিক আদর্শবাদীদের মধ্যে রুশাে উচ্চ স্থানের অধিকারী”

[1] রাষ্ট্রদর্শ: রুশাের রাষ্ট্রাদর্শের মূল তিনটি বিষয় হল প্রকৃতির রাজ্য (State of Nature), সামাজিক চুক্তি (The Social Contract), সাধারণ ইচ্ছা (General Will)। রুশাের রাষ্ট্রদর্শে গণতন্ত্র ও সাম্যের প্রতিফলন মেলে।

[2] রচনাসমূহ: রুশো রচিত উল্লেখযােগ্য তিনটি গ্রস্থ হল- আ ডিসকোর্স অন দ্য মরাল এফেক্টস অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সস’, ‘আ ডিসকোর্স অন দি অরিজিন অব ইন ইকুয়ালিটি’, ‘দ্য সােশ্যাল কন্ট্রাক্ট।

[3] গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের ব্যাখ্যা

  • প্রকৃতির রাজ্য: বুলশাের ধারণায় প্রকৃতির রাজ্য ছিল ভূস্বর্গ (Earthly Heaven) সম, যেখানে মানুষের মধ্যে মধুর ও আন্তরিক সম্পর্ক, সুখ-শান্তি বজায় ছিল। রুশাে বলেছেন“মানুষের মধ্যে চিন্তা ও বিচারশক্তির উন্মেষ ঘটলে পারস্পরিক ভেদাভেদ গড়ে ওঠে ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব ঘটে। ফলে প্রকৃতির রাজ্যের যাবতীয় সুখশান্তির অবসান হয়।”

  • সামাজিক চুক্তি মতবাদ: প্রকৃতির রাজ্যে ঘনিয়ে ওঠা অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যে মানুষ এক চুক্তি সম্পাদন করে। এই চুক্তির মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক বা পৌরসমাজারুশাের ধারণায় এই চুক্তিই হল সামাজিক চুক্তি। ‘সামাজিক চুক্তি (The Social Contract) গ্রন্থের প্রথম খন্ডে রুশাে লিখেছেন”মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মায়, কিন্তু সর্বত্র সে শৃঙ্খলাবদ্ধ”।

  • সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব: রুশাের সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রধান অঙ্গ হল—সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব। সামাজিক চুক্তির মধ্যে দিয়ে যে মিলিত শক্তি গড়ে ওঠে তা হল সাধারণ ইচ্ছা। ব্লুশাের ধারপায় ব্যক্তি মানুষের ইচ্ছা দু-ধরনের একটি হল প্রকৃত ইচ্ছা, অপরটি হল বাস্তব ইচ্ছা। রুশোর মতে, সাধারণ ইচ্ছা হল প্রকৃত ইচ্ছাগুলির গুণফল।

ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম মানবতাবাদী রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হলেন চার্লস লুই দ্য মন্তেষ্কু (১৬৮৯-১৭৫৫ খ্রি.)। তিনিই প্রথম রাষ্ট্রচিন্তাবিদ যিনি সমাজবিজ্ঞানী হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছেন।

[1] রাষ্ট্রদর্শ: মন্তেঙ্কুর রাষ্ট্রাদর্শের মূল কয়েকটি বিষয় ছিল রাষ্ট্রতত্ত্ব, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি, আইনের ধারণা, স্বাধীনতার তত্ত্ব প্রভৃতি।

[2] রচনাসমূহ: মন্তেস্কু রচিত উল্লেখযােগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হল—‘দ্য পারসিয়ান লেটারস’, ‘গ্রেটনেস অ্যান্ড ডেকলাইন অফ দ্য রােমানস’, ‘স্পিরিট অফ দ্য লজ’ প্রভৃতি।

[3] রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণা: মন্তেস্কুর ধারণায় রাষ্ট্র একটি আইনসম্মত সংগঠন। তার চিন্তায় রাষ্ট্রের কাজ হল ব্যক্তির নৈতিক জীবনের চলার পথের বাধাগুলিকে দূর করে তাদের মঙ্গলসাধনে ব্রতী হওয়া। মন্তেন্ধু তিন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার উল্লেখ করেছেন, যথা

  • প্রজাতন্ত্র: প্রজাসাধারণের হাতে যেখানে সমস্ত ক্ষমতা থাকে, তা হল প্রজাতন্ত্র।

  • রাজতন্ত্র: নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত আিন মেনে রাজা তার অধীনস্থ কর্মচারীদের নিয়ে যে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেন, তা হল রাজতন্ত্র।

  • স্বৈরতন্ত্র: আইনের তােয়াক্কা না করে, কোনাে একজন ব্যক্তি নিজের খেয়ালখুশিমতাে যে শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন, তা হল স্বৈরতন্ত্র।

[4] মন্তেস্কুর রাষ্ট্রত্ব

  • ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি: মন্তেস্কুর ধারণায় আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ (প্রশাসন) এবং বিচার বিভাগকে আলাদা করে দেওয়া উচিত। তিনি মনে করতেন এই তিনটি বিভাগের ক্ষমতা কোনাে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে কেন্দ্রীভূত হলে সাম্য ও স্বাধীনতা বিঘ্নিত হবে। মন্তেষ্কু বলেন- “পৃথিবীতে যত অশান্তি ও নিপীড়ন বা শােষণের ঘটনা রয়েছে তার মূলে আছে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন।”

  • আইনের ধারণা: মন্তেস্কু মনে করতেন সমস্ত বস্তুরই নিজ নিজ আইন রয়েছে। দেবতাকুল, মনুষ্য জগৎ এমনকি পশুদেরও নিজস্ব আইন রয়েছে। তার ধারণায় যেখানেই সম্পর্ক রয়েছে সেখানেই আইন রয়েছে। সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইনের প্রয়ােজন।

  • স্বাধীনতার তত্ত্ব: মন্তেন্ধুর স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা রয়েছে ‘দ্য স্পিরিট অফ লজ’ গ্রন্থে। মন্তেষ্কুর ধারণায় চরম বা অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা স্বাধীনতার পরিপন্থী। মন্তেষ্কু মূলত স্বাধীনতা বলতে রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে বােঝাতে চেয়েছেন।