প্রাচীন ভারতে, বিশেষ করে মৌর্য শাসনকালে (৩২৪- ১৮৭/১৮৫ খ্রি.পূ.) মগধে প্রাচীন গ্রিসের বা রােমের মতাে ক্রীতদাস প্রথার অস্তিত্ব ছিল কি না তা নিয়ে বিতর্ক আছে| প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইউরােপীয় প্রেক্ষাপটে ইংরেজি শব্দ ‘Slave’ এর বাংলা প্রতিশব্দ করা হয় ক্রীতদাস’ কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপটে তাদের ‘দাস’ বলেই অভিহিত করা হয়।

[1] মেগাস্থিনিসের অভিমত: মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে গ্রিক রাজা সেলুকাসের দূত মেগাস্থিনিস ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে আসেন। তিনি লিখেছেন যে, “ভারতে কোনাে ক্রীতদাস নেই, এখানে সবাই স্বাধীন। …ভারতীয়রা তাদের দেশবাসীদের সঙ্গে তাে নয়ই, এমনকি বিদেশিদের সঙ্গেও ক্রীতদাসের মতাে ব্যবহার করে না।”

[2] মেগাস্থিনিসের মতের গুরুত্ব: মেগাস্থিনিস ভারতে আসার কিছুকাল আগে গ্রিক রাজা সেলুকাস মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাছে সম্ভবত পরাজিত হয়েছিলেন। তখন যদি ভারতে ক্রীতদাস ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকত তবে নিশ্চয়ই সেলুকাসের অসংখ্য সৈন্য ভারতে ক্রীতদাসে পরিণত হত। কিন্তু তা যখন হয়নি তখন মেগাস্থিনিসের বক্তব্য সত্য বলে মনে করা অস্বাভাবিক নয়।

[3] ক্রীতদাস প্রথার অস্তিত্বের প্রমাণ: মেগাস্থিনিস ভারতে ক্রীতদাস প্রথার অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাচীন ভারতে ক্রীতদাস বা দাসপ্রথার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। [i] বৈদিক সাহিত্যে দাসদের উল্লেখ পাওয়া যায়। বহিরাগত আর্যরা ভারতের আদিম উপজাতিদের পরাজিত করে দাসে পরিণত করেছিল। [ii] বৌদ্ধ জাতকে দাসত্ব গ্রহণের বিভিন্ন কারণের উল্লেখ আছে। চতুষ্পদ জন্তু থেকে পৃথক করার জন্য বৌদ্ধগ্রন্থে দাসদের ‘দ্বি-পদ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। [iii] ‘মনুস্মৃতি’তে সাত, ‘অর্থশাস্ত্রে আট ও নারদস্মৃতি’তে পনেরাে ধরনের দাসের কথা জানা যায়। [iv] মহাভারত ও অশােকের লেখতেও এদের উল্লেখ আছে।

সিদ্ধান্ত: অধিকাংশ ইতিহাসবিদ প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। ইতিহাসবিদ রিস ডেভিডস্, মােনাহান প্রমুখ মনে করেন যে, “প্রাচীন ভারতে ক্রীতদাস প্রথার অস্তিত্ব ছিল, তবে মেগাস্থিনিস দাসদের চিনতে ভুল করেছিলেন।”

ভারতীয় দাসরা বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হত। এই কাজগুলি হল一

[1] গৃহভৃত্যের কাজ: ভারতের দাসরা তাদের প্রভুর পরিবারের গৃহস্থালির কাজ, রান্নাবান্না, ওই পরিবারের সদস্যদের শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের বন্দোবস্ত প্রভৃতি কাজ করত। দাসদের পরিশ্রমে তার প্রভুর পরিবারে অতিরিক্ত সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য আসত।

[2] কৃষকের কাজ: দাসদের একটি বড়াে অংশ প্রভুর কৃষিজমিতে ফসল উৎপাদন করত এবং তা মালিকের ঘরে পৌছে দিত। প্রভু তার দাসদের অর্থের বিনিময়ে অন্যের জমিতে ভাড়া খাটাতে পারত।

[3] শ্রমিকের কাজ: অনেক দাস শিল্প কারখানায় শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন সামগ্রী উৎপাদনের কাজে নিযুক্ত থাকত।

[4] পতিতাবৃত্তির কাজ: বেশি উপার্জনের উদ্দেশ্যে কোনাে কোনাে দাসীকে পতিতাবৃত্তির পেশা গ্রহণে বাধ্য করা হত।

[5] খনিশ্রমিকের কাজ: কোনাে কোনাে দাস মাটির গভীর থেকে বিভিন্ন খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কাজে নিযুক্ত হত।

উপসংহার: প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথার অস্তিত্ব থাকলেও তা কোনাে সময়ই ইউরোপের, বিশেষ করে রোমান সভ্যতার মতাে ব্যাপক আকার ধারণ করেনি। দাসপ্রথা প্রাচীন ভারতে কখনোই অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেনি।