মধ্যযুগের ইউরােপে সামন্ততান্ত্রিক সমাজে তিনটি শ্রেণি ছিল一
[1] যাজক শ্রেণি: সামন্ততান্ত্রিক সমাজে অতি সামান্য সংখ্যক যাজক থাকতেন। তাঁরা ছিলেন সামন্তসমাজের সবচেয়ে সুবিধাভােগী ও বিলাসপ্রিয় শ্রেণি। তাঁরা কৃষকদের কাছ থেকে নানা ধরনের কর আদায় করে কৃষকের জীবনে চরম দারিদ্র্য নিয়ে এসেছিলেন। তারা রাষ্ট্রকে কোনাে কর না দিলেও রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিভিন্ন বিশেষ সুযােগ (Privilege) লাভ করতেন।
[2] অভিজাত শ্রেণি: সামন্ত সমাজের দ্বিতীয় শ্রেণি ছিলেন অভিজাত শ্রেণি। অভিজাতরাও ছিলেন বিশেষ সুবিধাভােগী শ্রেণি। তারা সরকারকে কোনাে কর না দিলেও কৃষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন কর আদায় করতেন এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে বংশানুক্রমে বিশেষ সুযােগসুবিধা লাভ করতেন। অধিকাংশ সরকারি উচ্চপদগুলি তাদের থাকত।
[3] কৃষক শ্রেণি: তৃতীয় শ্রেণি ছিল অগণিত কৃষক। করভারে জর্জরিত সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক শ্রেণি প্রথম দুই শ্রেণির দ্বারা তীব্র শােষিত হত। রাষ্ট্র, গির্জা ও সামন্তপ্রভুদের বিভিন্ন ধরনের কর দিতে তারা বাধ্য হত। তাদের সঙ্গে উচ্চ দুই শ্রেপির কোনাে সামাজিক সম্পর্ক ছিল না।
সামন্তপ্রভু ও খ্রিস্টান গির্জা উভয়ই ম্যানরের দরিদ্র কৃষকদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করে তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলত।
[1] জমির খাজনা: কৃষক তার চাষের জমির জন্য ম্যানর-প্রভুকে নির্দিষ্ট পরিমাণ বার্ষিক খাজনা দিতে বাধ্য ছিল। এই খাজনা প্রদানে দুটি ঘটলে কৃষক জমিচ্যুত হত।
[2] কর্ডি বা বেগার: ম্যানরের বিভিন্ন শ্রেণির কৃষকরা প্রভুর খাসজমিতে সপ্তাহের একটি বিরাট অংশ জুড়ে বিনা পারিশ্রমিকে বেগার শ্রম দিতে হত। প্রভুর জমি চাষের পর কৃষক নিজের জমি চাষ করতে পারত। কৃষকের ফসল নষ্ট হলেও সে নিজের ফসল রক্ষার চেষ্টা না করে প্রভুর ফসল রক্ষায় বেগার শ্রম দিতে বাধ্য হত।
[3] বানালিতে: কৃষক সামন্তপ্রভুর কলে গম ভাঙাতে ও আঙুর পেষাই করতে, প্রভুর চুল্লিতে রুটি সেকতে বাধ্য ছিল। এর জন্য প্রভু যথেষ্ট কর আদায় করতেন। এগুলি ‘বানালিতে’ নামে পরিচিত। কোনাে কোনো ম্যানরে কৃষককের প্রয়ােজনীয় ষাঁড় বা শূকর অর্থের বিনিময়ে একমাত্র প্রভুই জোগান দিত।
[4] শিভাজ ও টাইলে: কোনাে কোনাে প্রভু তার অধীনস্থ প্রজাদের কাছ থেকে শিভাজ নামে মাথাপিছু কর এবং টাইলে নামে সম্পত্তি কর আদায় করত।
[5] প্রভুর ব্যবসা: সামন্তপ্রভু লবণের একচেটিয়া ব্যাবসার মালিক ছিলেন এবং সকল কৃষক প্রভুর কাছ থেকে লবণ কিনতে এবং বছরের নির্দিষ্ট একটি সময়ে প্রভুর কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মদ কিনতে বাধ্য ছিল।
[6] ধর্মকর: গির্জা কৃষকের কাছ থেকে তার উৎপন্ন শস্যের এক-দশমাংশ টাইদ বা ধর্মকর হিসেবে আদায় করত। এ ছাড়াও গির্জা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অজুহাতে দরিদ্র কৃষকদের কাছ থেকে আরও কয়েকটি কর আদায় করত।
[7] অন্যান্য কর: এ ছাড়াও প্রভুর রাস্তাঘাট, সাঁকো, জাঁতাকল, চুল্লি প্রভৃতি ব্যবহারের জন্য কৃষকরা প্রভুকে অর্থ দিতে বাধ্য ছিল। এ ছাড়া প্রভু কৃষকদের কাছ থেকে পশুচারণ কর, জলকর, বনকর প্রভৃতি আদায় করত। কৃষকের মেয়ের বিবাহ, ছেলের যাজক হওয়া, স্ত্রীর প্রতি দুর্ব্যবহার প্রভৃতির জন্য কৃষক তার প্রভুকে কর প্রদানে বাধ্য ছিল।
উপসংহার: সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যাজক ও অভিজাতরা বিভিন্ন ধরনের বিশেষ সুযােগসুবিধা ভােগ করলেও তারা রাষ্ট্রকে বিশেষ কোনাে কর দিত না। ফলে যাবতীয় করের বােঝা এসে চাপত দেশের হতদরিদ্র, নিঃস্ব, রিক্ত কৃষকদের ওপর। সামন্তপ্রভু, চার্চ ও অন্যান্যদের করের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করে কৃষক-পরিবার অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হত।
Leave a comment