সূচনা: খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতকে ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের চূড়ান্ত বিকাশ লক্ষ করা যায়। কিন্তু চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিভিন্ন কারণে পশ্চিম ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় অবক্ষয় শুরু হয় এবং ক্রমে তা পতনের দিকে এগিয়ে যায়।
[1] রক্ষণশীল উৎপাদন ব্যবস্থা: অধ্যাপক মরিস ডব মনে করেন যে, ক্রমশ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সামন্ততন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ ম্যানরগুলি উন্নত হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছিল। সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার এই চরিত্রগত রক্ষণশীলতার ফলে কৃষকের পরিশ্রম যেমন বেড়েছিল, কৃষি উৎপাদনের পরিমাণও তেমনি ব্যাহত হয়েছিল। কৃষি উৎপাদনের এই রক্ষণশীলতা সামন্ততন্ত্রের পতনের অন্যতম কারণ হয়েছিল।
[2] কৃষক বিদ্রোহ: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষক সম্প্রদায় সামন্তপ্রভু, গির্জা প্রভৃতির আরােপিত বিভিন্ন প্রকার করের চাপে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। তদুপরি প্রভুর জমিতে বিনা পারিশ্রমিকে বেগার খেটে তাদের জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। এজন্য তারা মাঝেমধ্যেই সামন্তপ্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত এবং তাতে শামিল হত দিনমজুর, কারিগর প্রমুখ সমস্ত নির্যাতিত শ্রেণিই।
[3] ভূমিদাস বিদ্রোহ: ভূমিদাসদের ওপর সামন্তপ্রভুদের সীমাহীন শােষণ ও নির্যাতনকে সামন্ততন্ত্রের পতনের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভূমিদাসদের স্বাধীনতা প্রায় ছিল না বললেই চলে। তীব্র অত্যাচার ও শােষণের ফলে বিভিন্ন স্থানে ভূমিদাস বিদ্রোহ সংঘটিত হতে থাকে যা সামন্ততন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়।
[4] জনসংখ্যা হ্রাস: ১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দ ইউরােপে প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথ নামে মহামারি ছড়িয়ে পড়লে কয়েক দশকের মধ্যে ইউরােপের অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। জনসংখ্যা হ্রাস পেলে মানুষের তুলনায় জমির অনুপাত বেড়ে যায়। কৃষক ও ভূমিদাসের স্বল্পতায় শ্রমশক্তির অপ্রতুলতার কারণে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং সামন্তপ্রভুর আয় কমে যায়। সামন্তপ্রভুর আয় বৃদ্ধির বিকল্প কোনাে পথ না থাকায় সামন্ততন্ত্র ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে।
[5] বাণিজ্যের প্রসার: ইতিহাসবিদ হেনরি পিরেন উল্লেখ করেছেন যে, ইউরােপে নগরসভ্যতা ও বাণিজ্যের প্রসারের ফলে ম্যানরগুলিতে নির্যাতিত বহু কৃষক ও ভূমিদাস মুক্ত জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ম্যানরের বহু ভূমিদাস এখানে পালিয়ে এসে শ্রমিকের কাজে যােগ দেয়। ফলে ম্যানরপুলির অবক্ষয় শুরু হয়ে যায়।
[6] বাণিজ্য পণ্য উৎপাদন: অর্থনীতিবিদ পল্ সুইজির মতে, দশম শতক থেকে বাণিজ্য ও রপ্তানি পণ্য উৎপাদন জনপ্রিয় হয়ে উঠলে ম্যানরগুলিতে প্রচলিত উৎপাদন পদ্ধতিতে তা সম্ভব হয়নি। অথচ পরিবর্তিত পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারে ম্যানরগুলিতে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনাও সম্ভব হয়নি। ফলে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি ভেঙে পড়তে থাকে।
উপসংহার: উপরিউক্ত বিভিন্ন কারণে পশ্চিম ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় ও পতন শুরু হয়। সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ ঘটতে থাকে। অবশ্য তখন আশ্চর্যজনকভাবে পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ায় এর উত্থান শুরু হয় যা দীর্ঘদিন অস্তিত্বশীল থাকে।
Leave a comment