সূচনা: ঐতিহাসিক হেনরি পিরেন মনে করেন যে, মধ্যযুগে ইউরােপের কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নগরের উৎপত্তির বিষয়টি খুবই সময়সাপেক্ষ ছিল। তবে দশম-একাদশ শতকে বাণিজ্যের প্রসার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ইউরােপে নগর প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। খ্রিস্টীয় একাদশ থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যে পশ্চিম ইউরােপে বিভিন্ন শহরের উৎপত্তির কয়েকটি কারণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

[1] শান্তি ও ক্ষিতিশীলতার প্রত্যাবর্তন: খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতক নাগাদ সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে এলে আবার পুরােনাে শহরগুলির পুনরুত্থান ঘটে। ক্রুসেডের ফলে এবং অন্যান্য কিছু কারণে বহু ভূমিদাস মুক্তি পেলে শহরগুলিতে সস্তা শ্রমিকের জোগান শুরু হয়।

[2] নিরাপত্তা বৃদ্ধি: নবম শতক থেকে সামন্তপ্রথার প্রসারের মাধ্যমে ইউরােপে নিরাপত্তা বাড়লে মানুষের জীবন-জীবিকার সুযােগ বৃদ্ধি হওয়ার মতাে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং যেসব নির্দিষ্ট জায়গায় জীবিকা অর্জনের সুযােগ বেশি ছিল, সেইসব জায়গায় জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে। এই স্থানগুলি পরবর্তীকালে ক্রমে নগরে পরিণত হয়।

[3] বাণিজ্যের প্রসার: কুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন স্থানের মধ্যে যােগাযােগ স্থাপিত হয় এবং বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। বাণিজ্যের অগ্রগতির ফলে বাণিজ্যকেন্দ্র গুলিতে জনসংখ্যা ক্রমে বাড়তে থাকে এবং এগুলি শহরে পরিণত হয়।

[4] শিল্পের প্রসার: কৃষিক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত উৎপাদন, প্রযুক্তির উন্নতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রভৃতির ফলে মধ্যযুগের ইউরােপে বিভিন্ন উৎপাদন শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। শিল্পকেন্দ্রগুলিতে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে এবং এগুলি ক্রমে নগরে পরিণত হয়।

[5] গির্জা ও মঠের ভূমিকা: মধ্যযুগে নির্মিত প্রচুর সংখ্যক গির্জা ও মঠ একদিকে বহিরাক্রমণের সময় স্থানীয় মানুষদের আশ্রয় দিত অন্যদিকে এগুলির অধীনে থাকা বিপুল পরিমাণ ভূসম্পত্তিতে প্রচুর কৃষক ও শ্রমিক কাজ পেত। ফলে গির্জা ও মঠ অঞ্চলে ক্ৰমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে যা নগরায়ণের পথ প্রস্তুত করে।

[6] প্রাসাদ-দুর্গের ভূমিকা: সামন্তপ্রভুদের ‘বুর্গ বা প্রাসাদ দুর্গগুলি মধ্যযুগে স্থানীয় শাসনের কেন্দ্র এবং বহিরাক্রমণের সময় স্থানীয় মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করত। জনসংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে দুর্গাঙ্গুলগুলি ক্রমে শহরে পরিণত হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, এই ধরনের নগরের নামের সঙ্গে ‘বুর্গ’ কথাটি যুক্ত। যেমন- হামবুর্গ, লুয়েমবুর্গ, লিনবুর্গ, মার্সিবুর্গ প্রভৃতি।

[7] ভৌগােলিক অবস্থান: নদী বা সমুদ্রের উপকূল, পাহাড়ের গিরিপথের নিকটবর্তী অঞ্চল, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এলাকা প্রভৃতি স্থানগুলি মানুষের বসবাস, অর্থনৈতিক কর্মসম্পাদন প্রভৃতির পক্ষে সুবিধাজনক হওয়ায় এসব স্থানে বিভিন্ন নগর গড়ে উঠতে থাকে।

[8] অন্যান্য কারণ: মধ্যযুগে ইউরােপের নগরগুলির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের ক্ষেত্রে অন্যান্য কয়েকটি কারণ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। যেমন一

  • দর্শনীয় স্থান: দর্শনীয় স্থান হিসেবে প্রাচীন রােম ও অন্যান্য নগরীর পুনরুজ্জীবন ঘটে।

  • শিক্ষাকেন্দ্র: শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্যারিস, প্যালারামাে প্রভৃতি স্থান সুপরিচিত হয়ে ওঠে।

  • স্থায়ী রাজধানী: এযুগে স্থায়ী রাজধানী গড়ে ওঠার ফলে ইউরােপের প্রতিটি দেশেই চেস্টার বা ব্রিস্টলের মতাে একটি করে রাজধানী শহরের উৎপত্তি ঘটে।

  • সামরিক কেন্দ্র: সামরিক কেন্দ্র হিসেবে ওয়েলস-এর মতাে স্থানগুলি শহরে পরিণত হয়।

উপসংহার: প্রাচীন রােমান সাম্রাজ্যের নগরগুলির ওপর ভিত্তি করেই ফ্রান্স, ইটালি প্রভৃতি দেশের বিভিন্ন নগরীগুলি গড়ে উঠেছিল। লন্ডন, ক্যান্টারবেরি, উইনচেষ্টার, লিঙ্কন প্রভৃতি নগরগুলিও এভাবেই গড়ে উঠেছিল বলে অনেকে মনে করেন।