প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন বণিক ও বিভিন্ন পেশার কারিগর-শিল্পীরা গিল্ড বা সংঘ গড়ে তুলেছিল। ‘নারদ-স্মৃতি, ‘বৃহস্পতি-স্মৃতি ও অন্যান্য সূত্র থেকে গিল্ডের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল

[1] নির্দিষ্ট পেশাগত ভিত্তি: বিভিন্ন পেশার সঙ্গে নিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের পৃথক পৃথক গিল্ড গড়ে তুলত। কামার, কুমাের, তাতি প্রভৃতি বিভিন্ন পেশার মানুষের পৃথক পৃথক সংঘ গড়ে উঠেছিল।

[2] কার্যকরী সংবিধান: কার্যাবলি পরিচালনার জন্য প্রতিটি পেশায় গিল্ডের নিজস্ব সংবিধান ছিল। গিল্ডের সকল সদস্য এই সংবিধানের নিয়মকানুন ও আচরণবিধি মেনে চলত।

[3] নিজস্বতা রক্ষা: নিজস্বতা বজায় রাখার জন্য প্রতিটি গিল্ডের পৃথক পতাকা, প্রতীক, সিলমােহর ও সৈন্যবাহিনী থাকত। এতে গিল্ডের সদস্যদের সংঘশক্তির প্রতি আস্থা বাড়ত।

[4] সদস্যদের সহায়তা দান: গিল্ডগুলি সদস্যদের বিপদের সময় পাশে দাঁড়াত, তাদের পরামর্শ দিত, সদস্যের পারিবারিক বিবাদের মীমাংসা করত, মৃত সদস্যের পরিবারের ভরণ- পােষণের দায়িত্ব নিত ইত্যাদি।

[5] অন্যান্য পদক্ষেপ: গিল্ডগুলি উৎপাদন ও বাণিজ্যের কাজ সচল রাখত, বিভিন্ন ব্যক্তির আমানত জমা রেখে ঋণ দিত, সরকারকে রাজস্ব প্রদান ও সামরিক সাহায্য করত ইত্যাদি।

প্রাচীন ভারতে গিল্ডগুলি একসময় যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করলেও একসময় এগুলির পতন ঘটে। পতনের কারণগুলি হল—

[1] ব্যক্তিগত বাণিজ্য: গিল্ডের সামগ্রিক বাণিজ্যের সমৃদ্ধির বদলে সদস্যরা ব্যক্তিগত বাণিজ্যকে সমৃদ্ধ করতে মনােযােগী হলে গিল্ডের বাণিজ্যিক ও আর্থিক সমৃদ্ধি হ্রাস পায়।

[2] রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ: গিল্ডের কাজকর্মে ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ গিল্ডগুলিকে দুর্বল করে দেয়।

[3] জাতিভেদের প্রভাব: গিল্ডের কাজের ক্ষেত্রে জাতি বা বর্ণের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া শুরু হলে নিম্নবর্গের বহু মানুষ গিল্ড থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিতে থাকে।

[4] ব্যক্তিমালিকানা: পূর্বে জমিতে রাজার অধিকার বেশি ছিল। পরে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রসার ঘটলে মানুষ ব্যক্তিগত কাজের দিকে বেশি নজর দেয় এবং গিল্ডের বাইরে। স্বাধীন ও স্বচ্ছলভাবে জীবিকা নির্বাহের অধিকারী হয়।

[5] কৃষির গুরুত্ব বৃদ্ধি: কৃষির অগ্রগতি এবং জমিতে কৃষকের মালিকানা বৃদ্ধির ফলে জমির কাজে ক্লমে বেশি সংখ্যায় কৃষক নিযুক্ত হতে থাকলে শিল্প বাণিজ্যে শ্রমিকের সংখ্যা কমে যায়। ফলে ব্যবসা ও গিল্ড উভয়ই দুর্বল হয়।

[6] রােম-ডারত বাণিজ্যের অবসান: ইতিহাসবিদ ড. ডি. ডি. কোশাম্বী মনে করেন যে, রােমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে ভারত-রােম বাণিজ্য বন্ধ হয়। ফলে গিল্ডগুলি ভেঙে পড়ে এবং এর সদস্যরা বর্ণভিত্তিক উৎপাদনের কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে বা দূরের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

উপসংহার: ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার গিল্ডগুলির প্রশংসা করে বলেছেন যে, “গুপ্তযুগে গিল্ডগুলি শক্তির কেন্দ্র এবং সংস্কৃতি ও অগ্রগতির একটি আধার হয়ে উঠেছিল। এযুগের গিল্ডগুলি যুগপৎ সমাজের শক্তি ও অলংকার ছিল।”