মাটি গঠনে প্রভাব বিস্তারকারী নিয়ন্ত্রকগুলি হল一 [1] জনক বা আদি শিলা, [2] ভূপ্রকৃতি, [3] সময়, [4] জলবায়ু ও [5] জীবজগৎ।
[1] জনক বা আদি শিলা : আদি শিলা মাটি গঠনে যে যে প্রভাব ফেলে তা হল一
-
আদিশিলার দ্বারা মৃত্তিকার ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম যেমন গ্রথন, কাঠামাে, জল ধারণক্ষমতা, বর্ণ, pH-এর মান প্রভৃতি নিয়ন্ত্রিত হয়। এজন্য বিভিন্ন শিলায় বিভিন্ন ধরনের মাটি গঠিত হতে দেখা যায়। যেমন- (i) গ্র্যানাইট ও নিস শিলায় ফেল্ডস্পারের পরিমাণ বেশি থাকলে কাদামাটি সৃষ্টি হয়। (ii) ব্যাসল্ট শিলা থেকে কৃয়মৃত্তিকা, ল্যাটেরাইট ও লাল মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। (iii) চুনাপাথর ও মারবেল থেকে রেনজিনা মাটি এবং সিলিকা-সমৃদ্ধ শিলা থেকে পডসল মাটি গড়ে ওঠে।
-
আদি শিলার প্রভাব সর্বাধিক হলে এন্ডােডায়নামােমরফিক মাটির উৎপত্তি হয়। যেমন লিথােসল, রেগােসল ও অ্যালুভিয়াম।
-
খনিজ লবণ, চুনাপাথর ও কোয়ার্টজসমৃদ্ধ মাটির রং সাদা, ধূসর ও কখনাে কখনাে জলপাই রঙের সবুজ হয়।
-
আদি শিলার খনিজ ফেলস্পার হলে কাদামাটির সৃষ্টি হয়। কাদামাটি বেশি হলে তা মাটির বিভিন্ন ধরনের কাঠামাে গঠনে সাহায্য করে।
[2] ভূপ্রকৃতি : ভূমির ঢাল, ঢালের অবস্থান, জলনিকাশি ব্যবস্থা ইত্যাদি মাটি গঠনে যে-যে প্রভাব ফেলে তা হল一
-
পার্বত্য ভূপ্রকৃতিতে মাটি গঠনে জনক শিলার প্রভাব বেশি। ভূমির ঢাল বেশি হওয়ায় চূর্ণীকৃত পদার্থ সহজেই অপসারিত হয় বলে মৃত্তিকার স্তর গঠন বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে, মৃত্তিকা অপরিণত বা নবীন অবস্থায় থাকে।
-
উপত্যকার উচ্চ অংশ থেকে নিম্ন অংশ পর্যন্ত মৃত্তিকা পরিলেখের পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন অর্থাৎ ক্যাটেনা লক্ষ করা যায়।
-
উত্তর গােলার্ধে পর্বতের দক্ষিণমুখী ঢাল অধিকতর উয়, আলােকিত ও আর্দ্র থাকায় এখানে ক্ষারধর্মী চুনময় মাটি সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ গােলার্ধে এর বিপরীত অবস্থা থাকায় আহ্নিক মাটি সৃষ্টি হয়।
-
ভূমির ঢাল অবতল হলে, মৃত্তিকা সঞ্চয়ের উপযােগী পরিবেশ গড়ে ওঠে। আবার ওই ঢাল উত্তল হলে ক্ষয়কার্যের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। একই ঢালের উধ্বাংশে মৃত্তিকার ক্ষয় বেশি ও জৈব পদার্থের সঞ্চয় কম হয়। কিন্তু নিম্নাংশে মৃত্তিকার গভীরতা ও জৈব পদার্থের সঞ্চয় বেশি হয়।
-
খাড়া ঢালযুক্ত ভূমিভাগে ক্ষয়কার্য বেশি এবং অনুস্রাবণ অপেক্ষা পৃষ্ঠপ্রবাহ বেশি হওয়ায় ভূমিভাগ উদ্ভিদহীন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে মৃত্তিকা অগভীর হয় এবং বােল্ডার, নুড়ি, পাথর, কাঁকর, বালি ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ থাকে।
[3] সময় : মৃত্তিকা গঠনে সময়ের ভূমিকা সঠিকভাবে নির্ণয় করা মুশকিল হলেও দেখা গেছে যে一
-
অপ্রবেশ্য পদার্থ অপেক্ষা বেলেপাথরের ন্যায় প্রবেশ্য পদার্থে মৃত্তিকা গঠন দ্রুতগতিতে সংঘটিত হয়। হিমবাহ क সঞ্চয়ের (Tills) ওপর মৃত্তিকা গঠিত হতে কয়েকশাে বছর লেগে যায় এবং ভারী ব্যাসল্টের ওপর মৃত্তিকার গঠন হতে আরও অনেক বেশি সময় লাগে।
[4] জলবায়ু : মৃত্তিকা গঠনে জলবায়ু সর্বাপেক্ষা সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জলবায়ুর দুটি প্রধান উপাদান হল一
-
বৃষ্টিপাত : বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও তীব্রতার দ্বারা মৃত্তিকার বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রিত হয় (i) বৃষ্টিপাত অধিক হলে মৃত্তিকায় হাইড্রোজেন আয়নের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে pH-এর পরিমাণ কমে, মৃত্তিকা আম্লিক হয়। (ii) অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে উদ্ভিদের প্রাচুর্য লক্ষ করা যায়। অধিক জৈব পদার্থের সঞ্চয়ের ফলে মৃত্তিকায় নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। (iii) অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে ক্যালশিয়াম কার্বনেট কার্বনেশন পদ্ধতিতে ক্যালশিয়াম বাইকার্বনেটে পরিণত হয়ে মৃত্তিকার অনেক গভীরে স্থানান্তরিত হয়। (iv) আর্দ্র-ক্রান্তীয় অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে রাসায়নিক আবহবিকার ত্বরান্বিত হয় এবং মৃত্তিকায় কদমের পরিমাণ বাড়ে। (v) আক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে এলুভিয়েশন পদ্ধতিতে পটাশিয়াম, সােডিয়াম, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম প্রভৃতি মৃত্তিকার উধ্বস্তর থেকে অপসৃত হয়। (vi) মরুভূমি অঞ্চলে বৃষ্টিপাত অল্প হওয়ায় রাসায়নিক আবহবিকারের মাধ্যমে ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম, সােডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম প্রভৃতি খনিজ থেকে মুক্ত হলেও, মৃত্তিকার উধ্ধ্বস্তর থেকে অপসৃত হয় না। (vii) বৃষ্টিপাত ও বাষ্পীভবনের অনুপাতের ওপর নির্ভর করে যেখানে ধৌত প্রক্রিয়ায় মুক্ত ক্যালশিয়াম অপসারিত হয়ে কেবলমাত্র অ্যালুমিনিয়াম ও লােহার অক্সাইড পড়ে থাকে, সেখানে পেডালফার (Pedalfer = Ped-Al-Fe-rs) মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। তুন্দ্রা, পডসল ও ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা—এর উদাহরণ। (viii) বাষ্পীভবন অপেক্ষা বৃষ্টিপাত কম হলে (শুষ্ক জলবায়ুতে) কৈশিক প্রক্রিয়ায় মৃত্তিকার নীচ থেকে ওপরের দিকে ক্যালশিয়াম কার্বনেট ও লবণ উঠে এসে মাটির ওপরের স্তরে সঞ্চিত হয়। এভাবে পেডােক্যাল (Pedocal = Pedo-ca-ls) মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়। চেস্টনাট, চারননাজেম মৃত্তিকা—এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
-
উষ্ণতা : উষ্ণতা দ্বারাও মৃত্তিকার বহু বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রিত হয় (i) উষ্ণতা বেশি হলে আবহবিকার ভূত্বকের নীচে অনেক গভীর পর্যন্ত ক্রিয়াশীল থাকে। (ii) তাপমাত্রা বেশি হলে মাটিতে জৈব পদার্থ ও নাইট্রোজেনের পরিমাণ হ্রাস পায়। (iii) আর্দ্র-ক্রান্তীয় অঞলে গড় বার্ষিক উয়তা বেড়ে গেলে রাসায়নিক বিয়ােজন বেশি হয় ও মাটিতে কাদার পরিমাণ বাড়ে। (iv) আর্দ্র-ক্রান্তীয় অঞ্চলে উষ্ণতা বেড়ে গেলে সিলিকা সেসক্যুঅক্সাইডের অনুপাত কমে যায়।
[5] জীবজগৎ : জীবজগতের প্রধান দুটি উপাদান উদ্ভিদ ও প্রাণী মাটি গঠনে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।
-
উদ্ভিদের শিকড় শিলার ফাটলের মধ্যে প্রবেশ করলে জল ও বাতাস চলাচলের পথ তৈরি হয়। এর ফলে যান্ত্রিক ও রাসায়নিকভাবে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়।
-
উদ্ভিদের শিকড় মাটির নীচে মরে ও পচে গেলে, এর থেকে উৎপন্ন অনেক জৈব অম্ল মাটিতে মিশে যায়। এ ছাড়া সজীব উদ্ভিদের শিকড় থেকে কার্বনিক অ্যাসিড ও অন্যান্য পদার্থ নির্গত হয়। এইসব অ্যাসিড ও অন্যান্য পদার্থ জলের মাধ্যমে মিশে শিলা ও খনিজের সঙ্গে বিক্রিয়া ঘটিয়ে মাটি গঠনে সাহায্য করে।
-
পিপড়ে, কেঁচো, ইদুর প্রভৃতি প্রাণী মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বিভিন্ন স্তরের উপাদানগুলির মিশ্রণ ঘটায়।
-
মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহাবশেষ বেশি থাকলে মাটি হিউমাসে পরিপূর্ণ হয় এবং মাটির রং কালাে হয়। এই মাটি উর্বর হয়। এ ছাড়া মাটির স্তর পুরু ও খনিজসমৃদ্ধ হয়।
Leave a comment