জলবায়ুর বিভিন্ন উপাদানের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের স্বাভাবিক উদ্ভিদের বিন্যাস ঘটে। জলবায়ুর উপাদানগুলির সঙ্গে উদ্ভিদের সম্পর্ক হল一

[1] সূর্যালোকের প্রভাব : সূর্যালােক ছাড়া গাছ বাঁচাতে পারে না, কারণ ক্লোরােফিলসংশ্লেষ, হরমোেনসংশ্লেষ, সালােক সংশ্লেষ, প্রজনন, বাম্পমােচন, অঙ্কুরােদগম, ফুল ফোটা প্রভৃতি কাজে আলােক প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ ভূমিকা পালন করে। যেমন

  • আলাের তীব্রতা (Intensity) উদ্ভিদের ফুল, ফল ও বীজের উৎপত্তিতে সাহায্য করে। উন্মুক্ত জায়গায় আলাের তীব্রতা বেশি বলে বৃক্ষগুলি স্থুল প্রকৃতির এবং চওড়া পাতাযুক্ত হয়, কিন্তু ঘন বনভূমিতে এদের কাণ্ড ও পাতা—উভয়ই লম্বা ও সরু হয়।

  • আলাের প্রকৃতি (Nautre) অর্থাৎ লাল, নীল ও অতি বেগুনি রশ্মির দ্বারা উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশ প্রভাবিত হয়।

  • আলাের স্থায়িত্বকালের (Duration) ওপর ফুলের প্রস্ফুটনকাল ও উদ্ভিদের বণ্টন ব্যবস্থা নির্ভর করে। যেসব উদ্ভিদের ফুল দিনের দৈর্ঘ্য বেশি না হলে প্রস্ফুটিত হয় না, সেসব উদ্ভিদ উচ্চ অক্ষাংশে জন্মায়। অন্যদিকে, যেসব গাছের ফুল তাড়াতাড়ি ফুটে যায়, সেসব গাছ নিম্ন অক্ষাংশে জন্মায়।

[2] অধঃক্ষেপণের প্রভাব : গাছের শারীরবৃত্তীয় ও অন্যান্য কাজের জন্য জল অপরিহার্য। বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, শিলাবৃষ্টি প্রভৃতি কারণে মাটির উপ-পৃষ্ঠীয় স্তরে জল জমা হয়। ওই জল গাছ প্রয়ােজন মতাে গ্রহণ করে। মাটির ভিতরের খনিজ পদার্থ দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। গাছ ওইসব পুষ্টিমৌল জলের মাধ্যমে গ্রহণ করে সালােকসংশ্লেষ, রস সংরক্ষণ প্রভৃতি ক্রিয়া সম্পন্ন করে। সজীব কোশের প্রােটোপ্লাজমের জন্য জল দরকার। তাই মাটিতে জলের সরবরাহ ও বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণের ওপর। উদ্ভিদের বৃদ্ধি, গঠন ইত্যাদি নির্ভর করে। এজন্য বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন প্রভাব ফেলে তেমনি ঋতুকালীন বৃষ্টিপাতের বণ্টনও লতা, গুল্ম, তৃণ ইত্যাদি জন্মানাের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন, শীতপ্রধান অঞ্চলে শুধুমাত্র বসন্তকালের বৃষ্টিপাতে লতানাে গুল্ম ও ঘাস প্রচুর জন্মায়। যেখানে গ্রীষ্মকাল উয় ও শুষ্ক, আবার শীতকালে ঠান্ডা বিশেষ থাকে না, সেইসব অঞ্চলে শুষ্ক গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ জন্মায়।

[3] তাপমাত্রার প্রভাব : মাটি থেকে উদ্ভিদের খাদ্যরূপে গৃহীত বিভিন্ন খনিজের মধ্যে দ্রুত রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে শ্বসন, বাম্পমােচন, অঙ্কুরােদ্গম ইত্যাদি শারীরবৃত্তীয় কাজকর্মের জন্য উয়তা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন বীজ থেকে অঙ্কুরােদ্গমের জন্য 20 °সে. থেকে 27 °সে. তাপমাত্রা দরকার। অত্যন্ত কম বা বেশি তাপমাত্রায় প্রােটোপ্লাজম নষ্ট হয় এবং কম তাপমাত্রা ও বেশি আর্দ্রতায় গাছের মূল পচে যেতে পারে।

এ ছাড়া কুয়াশা, মেঘ ইত্যাদি পরােক্ষভাবে গাছের বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন—আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন বা মেঘাচ্ছন্ন থাকলে সূর্যালােকের পরিমাণ কমে যায় ও আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে বাষ্পীভবন হ্রাস পায়। বাষ্পীভবন হ্রাস পেলে গাছের জলত্যাগের পরিমাণও কমে যায়। তাপমাত্রা কমে গেলে উদ্ভিদের কাজকর্ম কমে যায়। এজন্য নাতিশীতােয় অঞ্চলে শীতকালকে উদ্ভিদের বিশ্রামকাল বলা হয়।

[4] বায়ুপ্রবাহের প্রভাব : বায়ুপ্রবাহ বিভিন্নভাবে স্বাভাবিক উদ্ভিদের ওপর প্রভাব ফেলে

  • বেশি আর্দ্র বাতাস বাষ্পীভবন ও প্রস্বেদনের হারকে কমিয়ে দেয় এবং এর ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়। শুষ্ক বাতাসের চলাচল বেশি হলে বাষ্পীভবন বেশি মাত্রায় ঘটে, মাটি শুকিয়ে যায়, জলের ঘাটতি শুরু হয়। বাতাস শুষ্ক হলে শারীরবৃত্তীয়ভাবে গাছের প্রস্বেদন ক্রিয়া বেড়ে যায়। ফলে, কোশের রসস্ফীতিজনিত চাপ হ্রাস পায়, কোষের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও উদ্ভিদ আকারে খর্ব হয়ে পড়ে।

  • বায়ুর গতিবেগের জন্য গাছের কচি অংশগুলি যেমন- শাখাপ্রশাখা, পাতা ইত্যাদি কুঁকড়ে যায়। বায়ুবাহিত বালি, কাঁকর, কোয়ার্টজ প্রভৃতির আঘাতে উদ্ভিদের মুকুল, পাতা প্রভৃতির ক্ষতি হয়। এ ছাড়া বাহিত লবণকণার দ্বারাও গাছের ক্ষতি হয়।

  • বায়ু প্রবল বেগে প্রবাহিত হলে গতিবেগজনিত বিভিন্ন প্রকার যান্ত্রিক ও প্রত্যক্ষ প্রভাব উদ্ভিদের ওপর পড়ে। যেমন—যান্ত্রিক প্রভাবে গাছ উৎপাটিত হতে পারে, অথবা এর শাখাপ্রশাখা ভেঙে যেতে পারে। গাছ ক্রমান্বয়ে একপাশে হেলে গিয়ে বক্র গঠনযুক্ত হয়, স্বাভাবিক বৃদ্ধির বিঘ্ন ঘটে ও শাখাপ্রশাখাগুলি অনিয়মিতভাবে প্রসারিত হয়।

  • বায়ুপ্রবাহের ফলে উদ্ভিদের বীজ অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং গাছের বংশবিস্তারে সাহায্য করে। এ ছাড়া পরাগরেণু বায়ুপ্রবাহের ফলে অন্যত্র উড়ে যায় এবং পরাগমিলনে সাহায্য করে ও উদ্ভিদের বংশবিস্তার ঘটে।