সামগ্রিকভাবে কৃষিজাত খাদ্য উৎপাদনে ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ (চিনের পরে)। এমনকি জনসংখ্যার দিক থেকেও ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। সুতরাং, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পে কাঁচামাল, বাজার ও শ্রমিকের অভাব এই দেশে নেই। তা স্বত্ত্বেও পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহ—আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরােপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি থেকে ভারত এই শিল্পে অনেক পিছিয়ে। ভারতে এই শিল্পের অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাগুলি হল一

[1] উন্নত ও উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অভাব : এই দেশে খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উপযুক্ত স্বয়ংক্রিয় ও উন্নত যন্ত্রপাতির অভাব আছে। তাই এই সকল যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানি করার প্রয়ােজন হয়। কিন্তু সেগুলির দাম অত্যন্ত বেশি হওয়ার ফলে সেগুলির সরবরাহ স্থিতিশীল নয়।

[2] শ্রমিক-সংক্রান্ত সমস্যা : ভারতে উচ্চশিক্ষার হার কম হওয়ায় এই ধরনের শিল্পের জন্য প্রয়ােজনীয় দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব দেখা দেয়। এ ছাড়া প্রয়ােজনীয় ও স্বাচ্ছন্দ্যদায়ক সামগ্রীর অব্যবস্থা এবং মালিকশ্রেণির অনৈতিক কৌশলের ফলে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিতে মাঝেমাঝেই শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।

[3] কাচামালের অভাব : ভারতীয় কৃষিকাজ মৌসুমি জলবায়ু-নির্ভর হওয়ায় এই দেশের কৃষির উৎপাদন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অস্থিতিশীল। ফলে এই শিল্পের প্রয়ােজনীয় কাঁচামালের সরবরাহ সর্বদা একরকম হয় না। এ ছাড়া কাঁচামালের উর্ধ্বমুখী দাম, আমদানি ও পরিবহণ খরচ বেশি হওয়ায় শিল্পক্ষেত্রগুলিতে প্রায়ই কাঁচামালের অভাব দেখা দেয়। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলির সাপেক্ষে ভারতে কৃষির উৎপাদনের তুলনায় খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পে কাঁচামালের ব্যবহারের পরিমাণ অনেক কম হয়।

[4] অনুন্নত পরিকাঠামো : খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তােলার মতাে পরিকাঠামাে ভারতের সব রাজ্য বা অঞ্চলে পাওয়া যায় না। হিমায়িতকরণ ব্যবস্থার অভাব, অপর্যাপ্ত বিদ্যুতের জোগান, অনুন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা, শিল্প- থাপনের জন্য জমির অভাব ও জমির উচ্চমূল্য, সঠিক পরিচালন ব্যবস্থার অভাব প্রভৃতি ভারতে এই শিল্পের প্রসার ও অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়।

[5] আইনি অপ্রতুলতা : ভারতে খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের অন্যতম সমস্যা হল শিল্প প্রতিষ্ঠান ও সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে সুস্থ সংযােগের অভাব। এ ছাড়া ভারতে শুল্কের পরিমাণ অন্য দেশগুলির তুলনায় অনেক বেশি এবং জমি অধিগ্রহণ নীতির ক্ষেত্রেও বহু অস্পষ্টতা দেখা যায়। উদীয়মান শিল্প হওয়ায় সরকার এই ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কম অর্থ বিনিয়ােগ করে থাকে। ফলে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়।

[6] উন্নত দেশগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতা : বিশ্বের বাজারে ভারতীয় দ্রব্যগুলিকে উন্নত দেশগুলিতে উৎপন্ন দ্রব্যের সঙ্গে তীব্র প্রতিযােগিতার সম্মুখীন হতে হয়। ভারতীয় দ্রব্যের মান ও প্যাকেজিং উন্নত দেশগুলির তুলনায় নিম্নমানের হয় বলে, ভারতীয় দ্রব্যগুলি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনেক পিছিয়ে পড়ে। ফলে ভারতীয় কোম্পানিগুলি বিশ্ববাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছুক হয়।

[7] অন্যান্য কারণ : উপরােক্ত সমস্যাগুলি ছাড়াও আরও কিছু সমস্যা দেখা যায়, যেমন—মুদ্রাস্ফীতি, শিল্পদ্রব্য উৎপাদনে অসংগঠিত ক্ষেত্রের অধিক প্রধান্য, পরিবেশ দপ্তরের ছাড়পত্র পাওয়ার অসুবিধা, পুষ্টি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানের অভাব প্রভৃতি। এর ফলে এখনও ভারতে খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উন্নতি আশানুরূপ হয়নি।

[1] হিমারিতকরণ ব্যবস্থার উন্নতি : ভারতে যে পরিমাণ ফল ও সবজি এবং প্রাণীজ সম্পদ উৎপাদিত হয়, সেগুলির মাত্র 15%-এরও কম দ্রব্য হিমঘরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। তাই সরকার বর্তমানে হিমঘর নির্মাণের ব্যবস্থা নিয়েছে এবং এর জন্য ধার্য অর্থের পরিমাণ 2-2.7 বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বাড়িয়ে 8-10 বিলিয়ন মার্কিন ডলার করা হয়েছে। এ ছাড়াও দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু-সহ সারা দেশে আরও প্রায় 14টি হিমঘর নির্মাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

[2] বণ্টন ব্যবস্থার উন্নতি : উন্নত বণ্টন ব্যবস্থা শুধু যে উৎপাদিত দ্রব্যের দামকে স্থিতিশীল করতেই সাহায্য করে তাই নয়, এর ফলে বাজার এবং কৃষি ও শিল্প ব্যবস্থার মধ্যে সুসমন্বয়ও গড়ে ওঠে। বর্তমানে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিকে চাহিদার পূর্বাভাস দিতে, তথ্য সংগ্রহে ও সংরক্ষণে, অর্থনৈতিক পরিকাঠামাে গঠনে, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে সংযােগসাধনে সরকার উদারনীতি গ্রহণ করেছে।

[3] খাদ্যের মান-সংক্রান্ত উন্নতি : আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ দ্রব্যের চাহিদা ও বাজার বৃদ্ধি করতে সরকার WHO প্রদত্ত আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তা মানের দিকে বিশেষ লক্ষ রাখছে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিও খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনের ওই আন্তর্জাতিক মানকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করছে।

[4] মূলধনের বিনিয়োগ বৃদ্ধি : এই শিল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ রেখে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই বিনিয়ােগ যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। 1991 সালে ভারত উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করায় এই শিল্পে বিদেশি বিনিয়ােগের পরিমাণ খুব বেশি করে বাড়ছে।

[5] বাজার অধিগ্রহণ : ভারতের প্রতিবেশি দেশগুলি খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বিশেষ উন্নত না হওয়ায়, ভারত সরকার রপ্তানি শুল্কের হ্রাস ঘটিয়ে সেইসব দেশের বাজারগুলি অধিগ্রহণ করার চেষ্টা করছে।

[6] পরিকাঠামােগত উন্নতি : এই শিল্পের উন্নতির জন্য বিভিন্ন গবেষণাকেন্দ্র ও শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তােলা হয়েছে, যেমন—NIFTM, IICPT, NMPPB, APEDA, MPEDA ইত্যাদি। এই ধরনের দ্রব্যগুলি দেশীয় বাজারে বিক্রি বাড়াতে মহারাষ্ট্র, অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব, ঝাড়খণ্ড ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বেশ কিছু ‘Food Park গঠন করা হয়েছে। তার সঙ্গেই বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলিকে এই শিল্পে তাদের অংশীদারিত্ব বাড়াতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।