কোন্ ধরনের শিল্প কোথায় (কাঁচামাল উৎপাদক অঞ্চলে, না শক্তি সম্পদের কাছে, নাকি বাজারের সন্নিকটে) স্থাপন করলে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কম হবে, মুনাফা সর্বাধিক হবে ও ক্রেতারা সবচেয়ে কম দামে পণ্যটি পাবে, তা নির্ণয় করা সহজ নয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ, ভৌগােলিক ও বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন যেগুলিকে শিল্প অবস্থানের বা স্থানিকতার তত্ত্ব (Theory) বলা হয়।
পৃথিবীর প্রধান প্রধান শিল্প স্থানিকতা তত্ত্বসমূহ
-
আলফ্রেড ওয়েবারের শিল্প স্থানিকতার ন্যূনতম ব্যয় তত্ত্ব (1909 খ্রি.),
-
রিচার্ড হার্টশাের্নের আপেক্ষিক অবস্থান তত্ত্ব (1926 – 1927 খ্রি.),
-
ওয়াল্টার ক্রিস্টলারের সেন্ট্রাল প্লেস বা কেন্দ্রীয় অবস্থান তত্ত্ব (1933 খ্রি.),
-
অগাস্ট লােশের বাজার এলাকা তত্ত্ব বা সর্বাধিক মুনাফা তত্ত্ব (1940 খ্রি.),
-
জর্জ রেনারের নির্মাণ শিল্পের অবস্থানের নীতি (1947 খ্রি.),
-
মেলভিন গ্রিনহাটের শিল্প প্রতিষ্ঠানের অবস্থান-তত্ত্বে ও বাস্তবে (1956 খ্রি.) প্রভৃতি।
জার্মান অর্থনীতিবিদ অগাস্ট লােশ 1940 খ্রিস্টাব্দে জার্মান ভাষায় ‘Die raumliche Ordnung Der Wirtschaft’ 2e fATC অবস্থান বিষয়ে বাজার এলাকা তত্ত্ব বা সর্বাধিক মুনাফা তত্ত্ব সম্পর্কিত ব্যাখ্যা করেন। 1954 খ্রিস্টাব্দে ওগলম এটিকে The Economics of Location’ নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
মূলকথা : লােশের মতে শিল্প মালিকদের মূল লক্ষ্য হল সর্বাধিক মুনাফা অর্জন, তাই তারা শিল্প স্থাপনের জন্য বেছে নেবেন শিল্পজাত দ্রব্যের চাহিদা ও লাভ বেশি এমন স্থান, অর্থাৎ শিল্পটি চাহিদা বা বাজারের কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত হবে।
অনুমানসমূহ
-
শিল্প স্থাপনের অঞ্চলটি হবে সর্বত্র অভিন্ন ও বিস্তৃত সমতলভূমি এবং প্রয়ােজনীয় কাঁচামাল সবজায়গায় সমানভাবে পাওয়া যাবে।
-
পরিবহণ ব্যয়, জনসংখ্যার বণ্টন, অধিবাসীদের রুচি, জ্ঞান এবং কারিগরি দক্ষতা অঞ্চলের সব জায়গায় সমান।
-
অধিবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থা সর্বত্র একই প্রকার এবং অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য প্রাপ্য সুযােগসুবিধাও সব জায়গায় একই ধরনের।
-
অঞ্চলটি কৃষিকাজে স্বনির্ভর।
-
উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা সর্বত্র সমান এবং পণ্যের দাম যত কমে চাহিদা তত বাড়ে।
-
বাজারে পূর্ণাঙ্গ প্রতিযােগিতার বদলে একচেটিয়া প্রতিযােগিতা থাকবে।
শর্তসমূহ : অঞ্চলে অর্থনৈতিক সমতা আনতে লােশ কিছু শর্ত আরােপ করে一
-
অঞ্চলটির সর্বত্র শিল্পের সুবিধা সমানভাবে পৌঁছােবে। সুতরাং ওই অঞ্চলে নতুন শিল্প গড়ে ওঠা লাভজনক হবে না।
-
শিল্পের অবস্থান উৎপাদক ও উপভােক্তাকে সন্তুষ্ট করবে।
-
সংলগ্ন এলাকা থেকে উৎপাদিত দ্রব্য পাওয়ার সুবিধা উপভােক্তার থাকবে ইত্যাদি।
লোশের তত্ত্বানুসারে শিল্পের অবস্থান : লোশের মতে বাজারের কেন্দ্রে যেখানে মুনাফা সর্বাধিক, শিল্পটি সেখানে গড়ে উঠবে। তার মতে, প্রতিটি শিল্পের নিজস্ব বাজার থাকে এবং বাজারের আয়তন নির্ধারিত হয় অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে প্রতিযােগিতার মাধ্যমে। যে শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের দাম কম তার বাজার তত বড়াে হবে। এ ছাড়াও লােশ বলেন, প্রতি শিল্পের বাজার প্রথমে বৃত্তাকার হয়, পরে প্রতিযােগিতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাজার ভাগ হতে থাকলে তা ষড়ভুজের আকার নেয়। এই পরিবর্তন তিনটি পর্যায়ে হয়一
-
প্রথম পর্যায় : উৎপাদন কেন্দ্রে চাহিদা সর্বোচ্চ হবে এবং উৎপাদন কেন্দ্র থেকে ক্রমশ দূরের দিকে পণ্যের চাহিদা কমতে কমতে একসময় চাহিদা আর থাকবে না। উৎপাদন কেন্দ্র বা সর্বোচ্চ চাহিদা থেকে সর্বনিম্ন চাহিদা কেন্দ্র পর্যন্ত ব্যাসার্ধ নিয়ে যদি একটি বৃত্ত আঁকা যায়, তাহলে সেই বৃত্তটিই হবে শিল্পকেন্দ্রটির বৃত্তাকার বাজার। লােশ এই বৃত্তের মধ্যে বাজার বা চাহিদার অবস্থা বােঝাতে সর্বোচ্চ চাহিদা কেন্দ্র থেকে সর্বনিম্ন চাহিদা কেন্দ্র পর্যন্ত চাহিদা রেখা (Demand Line) টেনে ত্রিমাত্রিক শঙ্কু কল্পনা করেছেন, যাকে চাহিদা শঙ্কু (Demand Cone) বলা হয়।
-
দ্বিতীয় পর্যায় : পরিবহণ ব্যয় দূরত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ার জন্য একটি শিল্পকেন্দ্র সমগ্র অঞ্চলে শিল্পজাত দ্রব্য সরবরাহ করতে পারে না। তখন শিল্পটি সংলগ্ন এলাকার বাজার দখল করতে প্রতিযােগিতায় নামবে। ফলে বাজারের সীমানার আকার ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে সরলরেখার মতাে হবে।
-
তৃতীয় পর্যায় : যখন একাধিক উৎপাদক সমগ্র অঞ্চলের বাজারটি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে সমর্থ হবে তখন আর কোনাে শিল্পেরই বৃত্তাকার বাজার না থেকে, সেগুলি পরস্পর ষড়ভুজাকৃতির বাজারে পরিবর্তিত হবে। অর্থাৎ লােশের মতে, প্রতিটি শিল্পের নিজস্ব বৃত্তাকার বাজারের কেন্দ্রে পণ্যটি সবচেয়ে কম দামে সরবরাহ করা হয় বলে সেখানে চাহিদা ও বিক্রি বেশি এবং মুনাফাও বেশি। ফলে শিল্প গড়ে তােলার সবচেয়ে লাভজনক স্থানটি হল বাজারের কেন্দ্রস্থল। এমনকি বাজারের আকৃতি ষড়ভুজে পরিণত হলেও বাজারের কেন্দ্রেই মুনাফার পরিমাণ সর্বোচ্চ থাকে। তাই বাজারের কেন্দ্রেই শিল্প গড়ে ওঠে।
মূল্যায়ন : লােশের তত্ত্বটি ভালােভাবে বিশ্লেষণ করলে বােঝা যায়—এর মধ্যে যেমন বহু প্রশংসার দিক আছে, তেমনি কিছু দুর্বলতাও আছে一
-
সুবিধা বা গুণ : (i) লােশই প্রথম তার তত্ত্বে দেখিয়েছেন কীভাবে পর্যায়ক্রমে বাজার সৃষ্টি হয় এবং তার কেন্দ্রে শিল্প গড়ে ওঠে। (ii) লােশ তার তত্ত্বে শিল্পের অবস্থানে শিল্পসংস্থাগুলির মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতার ওপর যথার্থ জোর দেন। (iii) শিল্পের অবস্থান সম্পর্কে শিল্পদ্যোগীদের ধ্যান-ধারণার ইঙ্গিতও পাওয়া যায় তার তত্ত্বে। (iv) তিনি তাঁর তত্ত্বে বাজারের তাকৃতির মতাে অত্যন্ত সহজ পদ্ধতি ব্যবহার করে শিল্প স্থানিকতার কারণ ব্যাখ্যা করেন। (v) লােশ শিল্পের অবস্থানের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থার ধারণার কথা বলেন-এটাই তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব।
-
অসুবিধা : (i) লােশ বর্ণিত শিল্প স্থাপনের ও বাজারের আকারের এই প্রকার আদর্শ অবস্থা বাস্তবে দেখা যায় না। (ii) তিনি তার তত্ত্বে উন্নত কারিগরি কৌশল ও রাজনৈতিক বা সরকারি সিদ্ধান্তেরকোনাে উল্লেখই করেননি। (iii) লোশ তার তত্ত্বে কাঁচামালের মূল্য ও মজুরি হারের ওপর গুরুত্ব দেননি। (iv) তার তত্ত্ব শ্রমশিল্পের জটিল উৎপাদন পদ্ধতি ও ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে অবাস্তব।
Leave a comment