গ্রামীণ পরিবেশে বাসগৃহের বিন্যাসের ফলে বসতির যে বাহ্যিক রূপ ফুটে ওঠে, তাকে গ্রামীণ বসতির ধাঁচ বা আকার বলে। আকার অনুযায়ী গ্রামীণ বসতির শ্রেণিবিভাগগুলি নীচে আলােচনা করা হল一

[1] আয়তাকার জনবসতি : গােষ্ঠীবদ্ধ জনবসতির একটি অতি পরিচিত রূপ হল আয়তাকার জনবসতির বিন্যাস। বসতির এরূপ বিন্যাসের মূলে আছে কৃষিজমির আয়তক্ষেত্রিক বণ্টন। এরূপ বসতিতে একই সঙ্গে সারিবদ্ধভাবে অনেকগুলি বাড়িঘর তৈরি করা হয়। বাড়িঘরগুলি আয়তাকার বা বর্গাকারে বিন্যস্ত থাকার ফলে বসতির বাহ্যিক রূপ আয়তাকার হয়। ছােটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের আদিবাসীদের কুসংস্কার আছে যে, বর্গাকার বাড়িঘর নির্মাণ করলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়, তাই তারা আয়তাকার গৃহনির্মাণে বিশেষ উৎসাহী। এই অঞ্চলের এডাল, প্রতাপপুর, পিথাউরিয়া ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি আয়তাকার জনবসতির উদাহরণ।

[2] বর্গাকার জনবসতি : আয়তাকার বসতির প্রাথমিক রূপই হল বর্গাকার জনবসতি। এইপ্রকার বসতি বর্ধিত হয়ে আয়তাকার বসতিতে পরিণত হয়। সাধারণত কৃষিজমির মাঝে পায়ে চলা পথ বা রাস্তার সংযােগস্থলে বর্গাকার বসতি গড়ে ওঠে। প্রাকৃতিক বা সাংস্কৃতিক কোনাে কারণে এইপ্রকার বসতি আর বর্ধিত হতে না পারলে বসতিটি বর্গাকার বাহ্যিক রূপটি বহন করে চলে। ঝাড়খণ্ডের দাই পাড় বর্গাকার বসতির উদাহরণ।

[3] শূন্যগর্ভ আয়তাকার বা বর্গাকার বসতি : বর্গাকার ও আয়তাকার জনবসতির মাঝখানে চৌকো জলাশয়, মন্দির, মসজিদ বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য সংরক্ষিত জায়গা থাকলে তাকে কেন্দ্র করে শূন্যগর্ভ বর্গাকার বা আয়তাকার বসতি গড়ে ওঠে। ঝাড়খণ্ডের পালামৌ জেলায় এই ধরনের জনবসতি গড়ে উঠেছে। অতীতে যে সমস্ত অঞ্চলে প্রায়ই যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত, সেইসব অঞ্চলে এইরূপ বসতি গড়ে উঠত। এইসব গ্রামের মাঝখানে থাকত রাজা বা সম্রাটের দুর্গ এবং এই দুর্গের চারদিকে গ্রামবাসীরা বসতি গড়ে তুলত।

[4] দাবার ছকের আকারের জনবসতি : বড়াে ধরনের আয়তাকার জনবসতির বিশেষ রূপ হল দাবার ছকের আকারের জনবসতি। এই প্রকার জনবসতিগুলিতে পায়ে চলা পথগুলি জালিকার মতাে বিস্তৃত হয়। এই বসতিতে প্রধান পথ ও গৌণ পথ কিংবা গলিপথগুলি পরস্পরের সঙ্গে সমকোণে মিলিত হওয়ায় বসতিটি জালের আকার ধারণ করে। পরিকল্পিত গ্রাম্য বসতির ক্ষেত্রেই এই প্রকার বসতির বাহ্যিক রূপ ফুটে ওঠে। সিংভূম জেলার যদুগােড়ার বসতিটি দাবার ছকের আকারের (Chess Board Pattern) জনবসতির উদাহরণ।

[5] বৃত্তাকার জনবসতি : বসতি স্থাপনের আকর্ষণীয় উপাদান যেমন—মন্দির, মসজিদ, পুকুর প্রভৃতির অবস্থানকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকারে জনবসতি গড়ে ওঠে। কোনাে কেন্দ্রীয় অবস্থানে বিভিন্ন দিক থেকে কাঁচা বা পাকা পথ এসে মিলিত হলে সেখান থেকে দূরবর্তী স্থানগুলিতে যাতায়াতের সুবিধা হয়। ফলে, স্থানীয় লােকজন রাস্তার সংযােগস্থলের চারদিকে বৃত্তাকারে বসতি গড়ে তুলতে উৎসাহী হয়। ছােটোনাগপুর মালভূমির ধানওয়ারা একটি বৃত্তাকার বসতির উদাহরণ।

[6] অর্ধ-বৃত্তাকার বা ক্ষ্যান প্যাটার্ন জনবসতি : সাধারণত নদীর পাড়ে ফেরিঘাটের কাছে যেখানে সড়কপথ ও পায়ে চলা পথ শেষ হয় বা মিলিত হয় সেখানে অর্ধবৃত্তাকার জনবসতি গড়ে ওঠে। সবরকম সুবিধার কারণে মানুষ এখানে বসতি গড়ে তুলতে উৎসাহী হয়। ছােটোনাগপুর মালভূমিব স্বল্প উচ্চ ভূভাগে অবস্থিত বাদাম গ্রামের বসতিগুলি অর্ধবৃত্তাকার জনবসতি সৃষ্টি করেছে।

[7] তারকাকৃতির বসতি : বৃত্তাকার বসতি যখন পায়ে চলা পথ বা অন্য সড়কপথ বরাবর কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে বিস্তৃত হয়, তখনই ওই বসতির আকার নক্ষত্রের মতাে হয়। উত্তর-পশ্চিম ইউরােপ, ইয়াংসি কিয়াং সমভূমি ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে এইপ্রকার বসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়।

[8] ত্রিভুজাকৃতির বসতি : নদীর সঙ্গমস্থলে সাধারণত ত্রিভুজাকৃতির জনবসতি গড়ে ওঠে। ঘরবাড়ির বিন্যাস বা সম্প্রসারণ মূলত নদীর অবস্থান দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। নদীর দ্বারা আবদ্ধ এই ভূখণ্ডে যে জনবসতি গঠিত হয় সেটি নদীর উর্ধ্বগতির দিকে বিস্তৃত হতে থাকলে জনবসতি ত্রিভুজের আকার ধারণ করে।

[9] নীহারিকা বসতি : কোনাে অঞ্চলের বসতি কুণ্ডলীর আকারে বিন্যস্ত হলে, তাকে নীহারিকা বসতি বলে। কোনাে একটি আকর্ষণীয় স্থানকে কেন্দ্র করে যাতায়াতের পথ কুণ্ডলীর আকারে বিস্তৃত হলে, রাস্তাকে অনুসরণ করে জনবসতি কুণ্ডলীর আকারে বিস্তৃত হয়। সাধারণত এই ধরনের বসতির আকার বেশ ছােটো হয়। উত্তর ভারতের গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলে এইপ্রকার জনবসতি লক্ষ করা যায়।

[10] রৈখিক বসতি : রৈখিক বসতিকে অনেকগুলি নকশায় ভাগ করা যায়一

  • L-আকৃতি : গ্রাম অঞ্চলে যেখানে দুটি রাস্তা পরস্পর পরস্পরকে সমকোণে ছেদ করে বা সমকোণে বেঁকে যায়, সেখানে ‘L’ আকৃতির জনবসতি গড়ে ওঠে।

  • T-আকৃতি : কোনাে অঞ্চলে কোনাে রাস্তার বিপরীতে সমকোণে আর একটি রাস্তা এসে মিলিত হলে, ওই রাস্তার ধার বরাবর জনবসতি গড়ে ওঠে। এইরূপ বসতি অনেকটা T আকৃতি হয়।

  • Y-আকৃতি : কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে গ্রামের মধ্যে তিনদিক থেকে তিনটি রাস্তা এসে একটি বিন্দুতে মিলিত হলে এবং রাস্তা বরাবর জনবসতি গড়ে উঠলে বসতির আকার ‘Y আকৃতির হয়।

  • বক্র-রৈখিক : কখনাে কখনাে জনবসতি নদীবাক অনুসরণ করে রাস্তা বরাবর গড়ে উঠতে দেখা যায়। এইরূপ অবস্থায় জনবসতির বিস্তার অনেকটা বক্র-রৈখিক প্রকৃতির হয়। নদীবাঁক ছাড়াও অশ্বক্ষুরাকৃতির হ্রদ অঞ্চলেও এইরূপ উপবৃত্তাকার বসতি গড়ে ওঠে।

  • অঙ্গুরীয় : শঙ্কু আকৃতির পাহাড় বা মালভূমি অঞ্চলের ক্ষয়জাত পাহাড়কে ঘিরে বৃত্তাকার পথ অনুসরণ করে অঙ্গুরীয় বসতি গড়ে ওঠে। পূর্ব সিংভূম জেলার মধুবনী তাখনি অঞ্চলে এইরূপ বসতি গড়ে উঠেছে।

[11] দণ্ডাকৃতি জনবসতি : স্থানীয় আকর্ষণ ও প্রতিবন্ধকতার কারণে নদীর স্বাভাবিক বাঁধ বরাবর অথবা পাহাড়ের মৃদু ঢালবিশিষ্ট অভিক্ষিপ্তাংশ অংশ বরাবর দণ্ডাকৃতি জনবসতি গড়ে ওঠে। রৈখিক জনবসতি অপেক্ষা দণ্ডাকৃতি বসতিতে বাসগৃহের আড়াআড়ি বিস্তার অনেক বেশি। সুবর্ণরেখা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের বুরাবাকি গ্রাম দণ্ডকৃতি বসতির উল্লেখযােগ্য উদাহরণ। যদুগােড়া। ইউরেনিয়াম খনি অঞ্চলের উত্তর দিকে স্পার-অক্ষ অনুসরণ করে বড়াে গােবিন্দপুর ও ছােটো গােবিন্দপুরে এই প্রকার বসতি গড়ে উঠেছে। নদী উপত্যকার উর্বর নিম্নভূমিকে কৃষির জন্য সংরক্ষণ করতে স্পার অক্ষ বরাবর এই প্রকার বসতি বিস্তৃত হয়েছে।