বিভিন্ন স্থানে, প্রধানত প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক পরিবেশের পার্থক্যের জন্য গ্রামীণ বসতিগুলিকে বিভিন্নভাবে গড়ে উঠতে দেখা যায়। যেমন— কোথাও গড়ে উঠেছে ঘনসন্নিবিষ্টভাবে কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আবার কোথাও একটি সরলরেখা বরাবর। গ্রামীণ বসতিগুলির এরকম বিভিন্ন অবস্থান ও বাড়িগুলির পরস্পরের মধ্যে দূরত্বের পার্থক্য অনুসারে গ্রামীণ বসতিকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ কার হয়। যথা- [1] গােষ্ঠীবন্থ জনবসতি, [2] বিক্ষিপ্ত জনবসতি এবং [3] দণ্ডাকৃতি বা রৈখিক জনবসতি।
[1] গোষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি : মানুষ নিজের প্রয়ােজনে যখন একসাথে একটা নির্দিষ্ট স্থানে বসতি গড়ে তােলে অথবা একই প্রকৃতিক পরিবেশে হ্যামলেট বা পাড়াগুলি বাড়তে বাড়তে সংঘবদ্ধ বসতিতে পরিণত হয়, তখন সেই বসতিকে গােষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি বলে। প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদানগুলির গুণগত মানের স্থানিক পরিবর্তনের কারণে । গােষ্ঠীবদ্ধ বসতিগুলি এককেন্দ্রিক, দ্বিকেন্দ্রিক ও বহুকেন্দ্রিক १ হতে পারে। বসতবাড়িগুলি ভূমিভাগের কোনাে একটি মাত্র স্থানে কেন্দ্রীভূত হলে এককেন্দ্রিক জনবসতি বলে। কখনও বসতি একটি স্থানে সংঘবদ্ধ না হয়ে বৃহৎ অঞ্চলের কাছাকাছি। দুটি স্থানে বসতির কেন্দ্রীভবন ঘটতে পারে। একে দ্বিকেন্দ্রিক বসতি বলে। আবার একটি অঞ্চলে যখন বিভিন্ন স্থানে বসতির কেন্দ্রীভবন ঘটে তখন তাকে বহুকেন্দ্রিক বসতি বলে। বন্ধুর পার্বত্য ও মালভূমি অঞ্চলের কেবলমাত্র যেসব স্থানে মনুষ্যবাসের প্রয়ােজনীয় সকল উপাদান বর্তমান, সেইস ৰ স্থানে স্থানীয় সম্পদের ওপর নির্ভর করে গােষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি গড়ে ওঠে। যেমন—হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের কুলু উপত্যকায় অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকায় গােষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি গড়ে উঠেছে। কৃষ্ণা, কাবেরী প্রভৃতি নদীর বদ্বীপের মৃত্তিকা উর্বর বলে ওখানে গােষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি গড়ে উঠেছে।
বৈশিষ্ট্য
-
এরূপ বসতিতে বাড়িগুলি খুব কাছাকাছি বা পাশাপাশি অবস্থান করে। ফলে, বাড়িগুলির মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব খুব কম থাকে।
-
পরিবেশের প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপাদানগুলির গুণগত মান স্থানীয়ভাবে পরিবর্তিত হলে গােষ্ঠীবদ্ধ বসতিগুলি এককেন্দ্রিক, দ্বিকেন্দ্রিক বা বহুকেন্দ্রিক হতে পারে।
-
এরূপ বসতিতে অধিবাসীদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
-
এরূপ বসতিতে দোকান-বাজার প্রভৃতি অর্থনৈতিক এবং শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি সামাজিক সুযােগসুবিধা বেশি পাওয়া যায়।
[2] বিক্ষিপ্ত জনবসতি : বন্ধুর ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চলে, বিস্তীর্ণ তৃণভূমি বা অরণ্য অঞ্চলে এবং প্রতিকূল জলবায়ু অঞ্চলে ক্ষুদ্র পরিসরে কয়েকটি পরিবার একে অন্যের থেকে দূরে দূরে সম্পর্কহীন ও সংযােগহীন অবস্থায় বসতি নির্মাণ করে, তাকে বিক্ষিপ্ত জনবসতি বলে। মালভূমি ও পাহাড়ি অঞ্চলে অনিয়মিতভাবে বিক্ষিপ্ত জনবসতি দেখা যায়। এসব স্থানে যােগাযােগ ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত। ভারতের মালভূমি অঞ্চলে ভিল, কোল, মুণ্ডা উপজাতিদের মধ্যে এধরনের বসতি দেখা যায়। হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে, মধ্যপ্রদেশের চম্বল উপত্যকার গভীর অরণ্যাঞ্চলে, অসম ও উত্তরবঙ্গের তরাই অরণ্যভূমিতে বিক্ষিপ্ত জনবসতি দেখা যায়।
বৈশিষ্ট্য
-
বসতিগুলি আয়তনে অর্থাৎ বিস্তারে বেশ ছােটো হয়।
-
বসতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব বেশি থাকে, ফলে বসতিগুলিতে বসবাসকারী অধিবাসীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক তেমনভাবে গড়ে ওঠে না।
-
বসতিগুলির মধ্যে দূরত্ব বেশি হওয়ায় নিরাপত্তার যথেষ্ট অভাব থাকে।
-
দুর্গম অঞ্চলের বিক্ষিপ্ত বসতিগুলিতে শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযােগ খুবই কম।
-
এই প্রকার বসতি পরিবেশের পার্থক্য অনুযায়ী নিয়মিত ও অনিয়মিতভাবে গড়ে উঠতে পারে।
-
বসতিগুলির মধ্যে পরিবহণ ও যােগাযােগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত হয় না।
[3] রৈখিক জনবসতি : যে জনবসতি পথ, স্বাভাবিক বাঁধ, রেলপথ, খাল নদী ইত্যাদিকে অনুসরণ করে অনুদৈর্ঘ্যভাবে বিস্তৃত হয় এবং একটি রৈখিক নকশা গড়ে তােলে তাকে রৈখিক বসতি বলা হয়। প্রতিবন্ধকতার কারণে এসব বসতি পরিসরে বেশি বিস্তৃত হতে পারে না। যেমন—কুলু উপত্যকায় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বিয়াস নদীর ধারে রৈখিকভাবে জনবসতি গড়ে উঠেছে।
বৈশিষ্ট্য
-
রাস্তা, রেলপথ, নদীর স্বাভাবিক বাঁধ (levee), স্পার ইত্যাদির দু-পাশে নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে গােষ্ঠীবদ্ধ বসতি গড়ে তােলা সম্ভব হয় না। তখন স্থানীয় আকর্ষণের ফলে রাস্তা, রেলপথ নদীর স্বাভাবিক বাঁধ, স্পার ইত্যাদি বরাবর রৈখিক বা দণ্ডাকৃতির জনবসতি গড়ে ওঠে।
-
নদীর নিম্ন অববাহিকায় স্বাভাবিক বাঁধগুলি প্লাবনভূমি অপেক্ষা উঁচুতে অবস্থিত হওয়ায় বন্যার কোনাে আশঙ্কা থাকে না এবং নদীর জলের সহজ প্রাপ্যতার কারণেও নদীর তীরবরাবর জনবসতি গড়ে ওঠে।
-
আবার মালভূমি অঞ্চলের নদী উপত্যকার নিম্নভূমিকে কৃষিকাজে ব্যবহার করার জন্য স্পার অক্ষ বরাবর রৈখিক জনবসতি গড়ে ওঠে। যেমন যদুগােড়া ইউরেনিয়াম খনি অঞ্চলের উত্তর দিকে স্পার অক্ষ অনুসরণ করে গােবিন্দপুরে এই প্রকার ছােটো ও বড়াে গ্রাম্য জনবসতি গড়ে উঠেছে।
Leave a comment