আর্নস-এর মতে, জীব, উদ্ভিদ বা প্রাণী তাদের জীবনচক্রের যে-কোনাে সময়ে যে সমস্ত জৈব এবং অজৈব কারণগুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়, সেই কারণগুলির সমষ্টিকে পরিবেশ বলে।
ইউনাইটেড নেশনস্ এনভায়রনমেন্ট প্রােগ্রাম (1976)-এ দেওয়া সংজ্ঞা অনুসারে “পরিবেশ বলতে পরস্পর ক্রিয়াশীল উপাদানগুলির মাধ্যমে গড়ে ওঠা সেই প্রাকৃতিক ও জীবমণ্ডলীয় প্রণালীকে বোঝায়, যার মধ্যে মানুষ ও অন্যান্য সজীব উপাদানগুলি বেঁচে থাকে, বসবাস করে।”
অন্যদিকে, মনােবিজ্ঞানী বােরিং, লংফিল্ড এবং ওয়েল্ড (Boring, Longfield and Weild, 1961)-এর মতে, জিন ব্যতীত ব্যক্তির ওপর যা কিছু প্রভাব দেখা যায়, তাই হল পরিবেশ।
উওয়ার্থ এবং মার্কুইস (Woodworth and Marquis, 1948) এর মতে, জীবন শুরু হওয়ার পর ব্যক্তির ওপর বাইরের যা কিছু সক্রিয় হয় তাই হল পরিবেশ।
পরিবেশকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয় প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে মনােবিজ্ঞানী কার্ট লিউন পরিবেশকে তিনভাগে ভাগ করেছেন— প্রাকৃতিক পরিবেশ, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ।
প্রাকৃতিক পরিবেশ
প্রকৃতি নিজে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিটি জীবের সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে উপদানগুলি তৈরি করেছে, সেই উপাদানগুলির সমষ্টিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ বলে। খাদ্য, পানীয়, জলবায়ু, আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সম্পদ অর্থাৎ ব্যক্তির বসবাস ও জীবনধারণের জন্য যেসব প্রাকৃতিক উপাদানগুলি প্রয়ােজন হয় তারই সমষ্টি হল প্রাকৃতিক পরিবেশ।
এ ছাড়া আর একটি দিক থেকেও মানুষের আচার-ব্যবহার, জ্ঞানার্জন, সংস্কৃতি ইত্যাদির ওপর প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রভাব বিস্তার করে। অনেক সময় প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন—খরা, বন্যা, অগ্নুৎপাত, ভূমিকম্প ইত্যাদি মানুষের জীবনযাপনের অনুকূল নয়। আদিম যুগেই মানুষের এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কিন্তু তাদের কিছু করার ছিল না। কতকটা নিষ্ক্রিয়ভাবেই পরিবেশের প্রভাবকে তারা মেনে নিয়েছিল। তাকে ধবংসকারী দেবদেবী কল্পনা করে শান্ত করার জন্য পূজার্চনা করত। ক্রমশ বুদ্ধিবলে, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানার্জনের ফলে প্রাকৃতিক শক্তিগুলির ধ্বংসকারী ভূমিকা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঘড়বাড়ি, অস্ত্র, চাষ পদ্ধতি, আগুন জ্বালানাে, গাড়ির চাকা ইত্যাদি আবিষ্কার করতে শুরু করে। শুধু তাই নয় শক্তিগুলিকে সবলে এনে নিজের এবং সমাজ তথা সকলের কল্যাগসাধন করতে সক্ষম হয়। এব্যাপারে যে প্রক্রিয়াটি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে তা হল শিক্ষা। অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান, প্রতিকূল পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ এবং তাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার সাহায্যে মানবসভ্যতা এগিয়ে চলে।
সামাজিক পরিবেশ
বাবা-মা, পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়স্বজন, বন্ধু এবং সহপাঠী, শিক্ষক, প্রতিবেশী, কমিউনিটির সদস্য, গণযােগাযােগ, বিনােদনের উপায়সমূহ, ধর্মস্থান, ক্লাব, পাঠাগার, সামাজিক রীতিনীতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদি নিয়ে সমাজ পরিবেশ গঠিত।
সামাজিক পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান এবং শক্তিসমূহের সঙ্গে শিশু মানিয়ে চলে। ক্রমশ সে সমাজের সঙ্গে একাত্মবােধ করে এবং সমাজের একজন হয়ে ওঠে। ব্যাপক অর্থে একে আমরা সামাজিকীকরণ বলি। অর্থাৎ সামাজিক পরিবেশ সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তির আচরণকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, শিশু নিষ্ক্রিয় এবং যান্ত্রিকভাবে তার সমাজ পরিবেশকে মেনে নেয়, যুক্তিহীনভাবে সেটিকে গ্রহণ করে তা নয়। প্রয়ােজনমতাে সে সামাজিক পরিবেশকে পরিবর্তন ও উন্নত করতে সচেষ্ট হয়।
ওপরের আলােচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ বিশেষ করে প্রাকৃতিক এবং সামাজিক পরিবেশ ব্যক্তির জীবনের বিভিন্ন দিকের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
Leave a comment