ভূমিকা: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি শাখা। বলাবাহুল্য, এটি একটি অপেক্ষাকৃত নবীন গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল সামাজিক বিজ্ঞান বা শাস্ত্র। পৃথক শাস্ত্র বা স্বতন্ত্র পাঠ্য বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বর্তমানে সুপ্রতিষ্ঠিত। বিগত শতাব্দীর ত্রিশের দশক থেকে আন্তর্জাতিক সমাজের পরিবর্তনশীল প্রকৃতির কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি ও আলােচ্য বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনাে স্থায়ী সীমানা বা পরিধি বেঁধে দেওয়া সম্ভব হয়নি।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি ও বিষয়বস্তু

একটি পৃথক বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্বীকৃতিলাভ করলেও এর বিষয়বস্তুকে কখনােই সুনির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে আলফ্রেড জিমার্ন, নর্মান অ্যাঞ্জেল প্রমুখ আদর্শবাদীরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কতকগুলি আইনগত ও নৈতিক নীতি গড়ে তােলার উপর গুরুত্ব আরােপ করেছিলেন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনাক্ষেত্রের পরিধি ক্রমবর্ধমান।

বস্তুত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক শিবিরের আবির্ভাব, পুঁজিবাদী জোট ও সমাজতান্ত্রিক জোটের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই, বিশ্বরাজনীতির দ্বিমেরুপ্রবণতা, তৃতীয় বিশ্বের উদ্ভব, বহুসংখ্যক অতি-জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের উদ্ভব, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার প্রভৃতির ফলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনাক্ষেত্রের পরিধি পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুইসি রাইট বলেছেন যে, বিভিন্ন ধরনের সংঘ, জাতি, রাষ্ট্র, সরকার, জনগণ, আঞ্চলিক জোট, আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচ্য বিষয় বস্তুর পরিধি যথেষ্ট সম্প্রসারিত করেছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রকৃতি

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শাস্ত্র অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় নবীন। এর সংশােধন ও প্রসারণের কাজ আজও চলছে, কারণ বর্তমান দুনিয়া সতত পরিবর্তনশীল। অথচ প্রথম পর্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলােচনায় গােপন কূটনীতির অবসান ও প্রকাশ্য কূটনীতির আলােচনা শুরু করা হয়। বিশেষত, সারা বিশ্বে যুদ্ধ ও শান্তি সংক্রান্ত আলােচনা মুখ্য হয়ে ওঠে। সেই কারণে বাস্তববাদী তত্ত্বের লেখক ই এইচ কার বলেছেন, দীর্ঘদিন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচ্য বিষয় ছিল যুদ্ধের সম্ভাবনা রােধের উপায় বার করা। মূলত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়গুলি কূটনীতিবিদদের দ্বারা পরিচালিত ও নির্ধারিত হয়। বিশেষত মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলসন তার চোদ্দো দফা প্রস্তাবে সর্বপ্রকার গােপন কূটনীতির অবসান, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে চেয়েছিলেন। বস্তু উইলসনের চিন্তা ভাবনার ফলে গড়ে ওঠে জাতিসংঘের মতাে আন্তর্জাতিক সংগঠনটি। এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিতকরণের চেষ্টা হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ব রাজনীতিতে আদর্শ বাদী চিন্তা ধারার পরিবর্তে বাস্তববাদী তত্ত্বের বিস্তার ঘটে। বাস্তববাদী তত্ত্ব, ঘটনা ও পরিস্থিতির কার্যকারণ ব্যাখ্যা করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঠান্ডা লড়াই ও তার বিস্তার এবং দ্বিমেরু রাজনীতির বিষয়গুলি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনায় স্থান পায়। ক্রমশ এভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তাত্ত্বিক আলােচনা শুরু হয়।

অধ্যাপক জিমার বলেন, একটি সাধারণ পাঠ্য বিষয় হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে বিবেচনা করা অসম্ভব। কারণ, সুনির্দিষ্ট ও সুসংবদ্ধ কোনাে পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, আসলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটি অংশ। তবে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বতন্ত্র পাঠ্য বিষয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু

বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচ্য বিষয় হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ নিম্নে আলােচনা করা হলㅡ

(১) আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক: রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বহু বিষয় দ্বারা প্রভাবিত হয়। এইসব বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ঐতিহাসিক উপাদানসমূহ, ভৌগােলিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ধর্মীয় ও মতাদর্শগত অবস্থা, সামরিক বিচারে অবস্থানগত তাৎপর্য এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মানসিকতা প্রভৃতি। প্রত্যেক রাষ্ট্র অন্যসকল রাষ্ট্রের কাছে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয় না।

(২) পরস্পর বিরোধী জাতীয় স্বার্থ: আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তাদের মতে, বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরী সম্পর্কের অস্তিত্ব স্বাভাবিক। এই ধারণার ভিত্তিতেই মৌলিক মতবাদগুলি গড়ে ওঠে। মরগেনথাউ-এর মতাে বাস্তববাদী তাত্ত্বিকবৃন্দ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ, শক্তি এবং ক্ষমতার উপর গুরুত্ব আরােপের কথা বলেন।

(৩) আন্তর্জাতিক সংগঠন: আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তুর মধ্যে আন্তর্জাতিক সংগঠন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন— সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ও জাতিপুঞ্জের অন্তর্ভুক্ত সংস্থাসমূহ প্রভৃতি।

(৪) ঠান্ডা লড়াই: ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের বক্তৃতা ঠান্ডা লড়াই, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পর্যালােচনার ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়।

(৫) শক্তি-সামর্থ্য: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুই বা ততােধিক রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাতের ফলাফল মূলত বিবদমান রাষ্ট্রসমূহের শক্তি-সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল। ক্ষমতার রাজনীতি, সংঘর্ষ, ফলাফল, আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুশীলবদের ক্রিয়াকলাপ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম বিষয় হিসেবে গণ্য হয়।

(৬) নয়া উপনিবেশবাদ: আধুনিককালে সাবেকি সাম্রাজ্যবাদী উদ্যোগ আয়ােজনের পরিবর্তে নতুন পথে ও নতুনরূপে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনাক্ষেত্রের একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।

(৭) জাতীয় মুক্তি আন্দোলন: পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংগঠিত জাতীয় মুক্তি আন্দোলন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলোচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এশিয়া ও আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী দেশের ঔপনিবেশিকতাবাদ-বিরােধী মুক্তি আন্দোলন এবং প্রতিবন্ধকতাসমূহ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু হিসেবে আলােচিত হয়।

(৮) সন্ত্রাসবাদ: বর্তমানে সন্ত্রাসবাদ বিশেষ কোন দেশের জাতীয় সমস্যা নয়। সেই কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনায় সন্ত্রাসবাদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ জাতি-রাষ্ট্রের সীমানা লঙ্ঘন করে বিশ্বে বহু মানবসম্পদ ও স্থাপত্যের ধ্বংসলীলাকে উন্মত্ত করে তুলেছে। তা ছাড়া বিশ্বে অহরহ এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এই সমস্যা এখন আন্তর্জাতিক সমস্যা, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ আলােচ্য বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়।

(৯) যুদ্ধ ও শান্তি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক কুড়ি বছরের মাথায় (১৯১৯-১৯৩৯ খ্রি.) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার লিটল বয় এবং ফ্যাটম্যান নামক বিধ্বংসী পরমাণু বোমার আঘাতে বহু প্রাণহানি, সম্পদহানি বিশ্ববাসীকে মহা আতঙ্কগ্রস্ত এবং বিপদের সম্মুখীন করে তােলে। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি পৃথিবীর আর কোনাে রাষ্ট্রনায়ক চান না, তাই তারা আঞ্চলিক জোটগঠন, বিবাদ-বিসংবাদ নিরসনে বিভিন্ন সম্মেলনে মিলিত হয়ে বিভিন্ন সমস্যার শান্তিপূর্ণ মীমাংসার মাধ্যমে সংঘাত এড়িয়ে যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই এই বাণী বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চান, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ আলােচ্য বিষয় হিসেবে গণ্য হয়।

(১০) জোট নিরপেক্ষ রাজনীতি: জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক, শক্তি-সামর্থ্য, সম্মিলিত জাতি পুঞ্জে জোট নিরপেক্ষ দেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

(১১) বেসরকারি সংগঠনসমূহের ভূমিকা: বেসরকারি সংগঠনসমূহের ক্রিয়াকলাপ, প্রভাব-প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

আলােচনাক্ষেত্রের পরিধি বা বিষয়বস্তু ক্রমবর্ধমান: সাম্প্রতিককালের বহু ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিধি ক্রমেই প্রসারিত করে চলেছে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্ব রাজনীতিতে এক মেরু কেন্দ্রিকতা, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রসার এবং প্রসাররােধ সংক্রান্ত চুক্তি, গ্যাট চুক্তির মাধ্যমে গড়ে ওঠা বিশ্বায়ন, মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতিকে বহুলাংশে পালটে দিয়েছে। তাই বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তু বা পরিধি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও মানব প্রকৃতির আলােচনা দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনার সূত্রপাত ঘটলেও সময় ও কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই শাস্ত্র নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছে বলে এই শাস্ত্রটি গতিশীল শাস্ত্রে পরিণত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তুকে অভিনবত্ব প্রদান করেছে। সুতরাং বলা যায় যে, পরিবর্তনশীল পাঠ্য বিষয় রূপে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এক পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।