বর্তমান বিশ্বরাজনীতির আঙিনায় জাতীয় স্বার্থ হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। বলাবাহুল্য, জাতীয় স্বার্থ হল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাজনীতির অন্যতম মৌলিক ধারণা। জাতীয় স্বার্থ বলতে যাবতীয় মূল্যবোধের সমষ্টি’ (Sum Total of all the national values)-কে বােঝায়। বিভিন্ন অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় স্বার্থের ধারণা বিশ্লেষণ করেছেন।

রাষ্ট্র দার্শনিক প্লেটোর মতানুসারে, নগররাষ্ট্রের স্বার্থের সহায়ক সব কিছুই হল জাতীয় স্বার্থ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আদিপুরুষ গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টটল জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর পছন্দ-অপছন্দের উপর জোর দিয়েছেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কৌলম্বিস ও উঠে-এর মতানুসারে জাতীয় স্বার্থ হল জাতি-রাষ্ট্রসমূহের বিষয়গত ও বিষয়ীগত দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়। অধ্যাপকহার্টম্যান বলেন যে, জাতীয় স্বার্থ হল বিভিন্ন ধরনের আকাঙ্ক্ষা যা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন করতে চায়।

অধ্যাপক জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেলের মতে, বিদেশ নীতি বা পররাষ্ট্রনীতির একটি মুখ্য ধারণা হল জাতীয় স্বার্থ। তার ভাষায়, অধ্যাপক আব্দুল আজিজ সৈয়দ বলেছেন যে, জাতীয় স্বার্থ বলতে সেইসকল মূল্যবােধকে বােঝায় যেগুলি সরকারি প্রশাসক বা নীতি নির্ধারণকারীগণ রাজনৈতিক কার্যাবলির ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করেন।

অধ্যাপক হ্যান্স জে মরগেনথাউ মনে করেন যে, জাতীয় স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল নির্যাস হল জাতীয় স্বার্থের ধারণা। তিনি বলেছেন, জাতীয় স্বার্থের ধারণা নির্ভর করে সেইসকল রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিষয়ের উপর, যার মাধ্যমে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয়।

কোন দেশের জাতীয় স্বার্থ সেই দেশের অতীত ঐতিহ্য, নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সেই দেশটির ভূমিকা ইত্যাদির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই জাতীয় স্বার্থের মুখ্য প্রয়ােগকারীরা হলেন কোনাে রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কখনাে বা শাসকগােষ্ঠী তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে ব্যক্ত করেছেন।

(১) জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত ভিন্ন মত: জাতীয় স্বার্থকে নানা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। পল সিবিউরি তিনটি অর্থে জাতীয় স্বার্থকে ব্যাখ্যা করেছেনㅡ

  • প্রথমত, জাতীয় স্বার্থ হল একটি আদর্শস্থানীয় উদ্দেশ্যের সমষ্টি।
  • দ্বিতীয়ত, জাতীয় স্বার্থ হল সেইসকল উদ্দেশ্যের সমষ্টি, যা জাতি এবং তার নেতৃবৃন্দ অনুসরণ করে থাকেন।
  • তৃতীয়ত, জাতীয় স্বার্থ বাস্তবায়নের বিষয়ে ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর মধ্যে মতপার্থক্যের সম্ভাবনাও জড়িত থাকে।

জোসেফ ফ্র্যাঙ্কেল-এর মতানুসারে, জাতীয় মূল্যবোধ সমূহের সমষ্টিই হল জাতীয় স্বার্থ। এ ছাড়া জর্জ কেন্নান-এর মতে, বস্তুতপক্ষে আমরা যা জানতে এবং অনুধাবন করতে পারি, তাকেই জাতীয় স্বার্থ নামে অভিহিত করা হয়।

অপরদিকে হলসটির মতে, অনেকসময় জাতির লক্ষ্য ব্যাখ্যার মাধ্যমরূপে জাতীয় স্বার্থের ধারণা প্রয়ােগ করা হয়। বাস্তববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা হ্যান্স জে মরগেনথাউ-এর মতে, ক্ষমতালাভ ও জাতীয় স্বার্থ অভিন্ন। মূলত, ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনেতারা তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন। তার মতে, কোনাে দেশের বিদেশ নীতি তত্ত্বগতভাবে জাতীয় স্বার্থ ও মতাদর্শের ভিত্তিতে স্থিরীকৃত হয়। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষাকারী ভৌগােলিক সংহতি সংরক্ষণের আবশ্যক হল সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামাে সংরক্ষণ।

(২) জাতীয় স্বার্থ ও ক্ষমতা: আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রতিটি রাষ্ট্র তার বিদেশ নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় ক্ষমতাকে গুরুত্ব দেয়। বলা যেতে পারে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় ক্ষমতার নির্ধারক দ্বারাই জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। বস্তুত জাতীয় স্বার্থের ধারণার সঙ্গে কোনাে দেশের টিকে থাকার প্রশ্ন জড়িত আছে। প্রতিটি রাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থ নির্ধারণে ভৌগােলিক সংহতি সর্বদা রক্ষা করতে চায়। কোনাে রাষ্ট্রের ভৌগােলিক সংহতি নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামাে, দেশের জনগণের গ্রহণ ও স্বীকৃতি প্রদানের উপর। এই সমস্ত বিষয়গুলিই জাতীয় স্বার্থের প্রকৃতি বা ধারণার মধ্যে জড়িত রয়েছে।

(৩) জাতীয় স্বার্থের প্রাসঙ্গিকতা: আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাতীয় স্বার্থের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। বলা যেতে পারে, জাতীয় স্বার্থ হল বিশ্ব রাজনীতির মুখ্য নির্ধারক, বিশেষণ বিদেশ নীতির যাত্রা শুরু হয় জাতীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করে। একটি দেশের বিদেশ নীতি নির্ধারণে যত মহৎ উদ্দেশ্য পালনের কথা বলা হােক-না-কেন শেষপর্যন্ত কিন্তু জাতীয় স্বার্থ সকল উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে যায়। আজকের দিনে পৃথিবীতে যেসকল ঘটনাগুলি ঘটে যেমন— যুদ্ধ ও শান্তি সংক্রান্ত বিষয়, ঠান্ডা যুদ্ধ, জোটনিরপেক্ষতা, শক্তিভারসাম্য, মেরুকেন্দ্রিক রাজনীতি, প্রতিটি ধারণার পিছনে জাতীয় স্বার্থ সক্রিয়ভাবে কাজ করে।

জাতীয় স্বার্থকে অবহেলা করা কোনাে দেশের পক্ষেই সম্ভব নয়। জাতীয় স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতেই একটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দর কষাকষির রাজনীতিতে কতটুকু লােকসান করল তার হিসাব সহজেই করা যায়। একটি দেশের জাতীয় স্বার্থের মধ্যে ভৌগােলিক অখণ্ডতা রক্ষা, দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, জাতীয় উন্নয়ন, অর্থনৈতিক ক্ষমতা,সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা, জাতীয় মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়গুলি জড়িত আছে।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান সময়েও পূর্ণমাত্রায় জাতীয় স্বার্থের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। কোনাে রাষ্ট্রের পক্ষে জাতীয় স্বার্থকে অবহেলা করে বিদেশ নীতি রচনা করা সম্ভব নয়। বিশেষত, জাতীয় ক্ষমতার উপর ভিত্তি করেই জাতীয় স্বার্থের চাহিদা নির্ধারিত হয়। অনেকে জাতীয় স্বার্থের ধারণাকে অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট এবং আপেক্ষিক বলে সমালােচনা করলেও এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক উপাদান হিসেবে জাতীয় স্বার্থের কোনাে বিকল্প এখনও কিন্তু গড়ে ওঠেনি।