ভূমিকা: রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্বন্ধে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। গ্রিক দার্শনিকরা রাষ্ট্রকে দেখেছেন নৈতিক লাভের একটি প্রয়ােজনীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে। আদর্শবাদীদের মতে, রাষ্ট্র হল আত্মসচেতন চরম নৈতিক সত্তা। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার পরিমণ্ডলে মার্কসীয় দর্শন এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে। রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি সম্পর্কে এক সাড়া জাগানাে বৈজ্ঞানিক মতবাদ হল মার্কসবাদ। মার্কসের রাষ্ট্রচিন্তা প্রধানত মার্কস-এঙ্গেলস রচিত The Communist Manifesto (1848)’, এঙ্গেলসের—The Origin of the Family, Private Property and the State (1884)’, লেনিনের “The State and Revolution (1917)’ এবং মার্কসের ‘The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte (1852)‘ নামক প্রবধ্মে প্রকাশিত হয়। এইসকল গ্রন্থেই মার্কসের রাষ্ট্রচিন্তার মূল সূত্রগুলি অর্থাৎ রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতির সন্ধান পাওয়া যায়।

কার্ল মার্কসের রাষ্ট্রচিন্তা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ল্যাস্কির ভাষায় প্রথমেই বলতে হয় যে, আজ পৃথিবীর যেখানেই মানুষ সমাজ উন্নয়নের জন্য সচেষ্ট হয় সেখানেই তাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে মার্কসীয় রাষ্ট্রচিন্তার দর্শন খুঁজে পাওয়া যায়।

মার্কসের রাষ্ট্র সম্পর্কিত তত্ত্ব গুলি নিম্নে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করা হল一

(১) আকস্মিকভাবে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়নি: কার্ল মার্কস মনে করেন রাষ্ট্র কোনাে চিরন্তন শাশ্বত প্রতিষ্ঠান নয় এবং কোনাে কল্যাণকামী প্রতিষ্ঠান নয়, রাষ্ট্র হল বল বা শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি কৃত্রিম প্রতিষ্ঠান। প্রাচীনকালে রাষ্ট্র ছিল না। আদিম সাম্যবাদী সমাজ ছিল রাষ্ট্রহীন। পরবর্তীকালে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব হওয়ায় মানুষে মানুষে মতভেদ (দ্বন্দ) বা শ্রেণিদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে শােষণ ও বলপ্রয়ােগের প্রয়ােজন হওয়ায় সমাজে এক বিশেষ শক্তি হিসেবে মানুষই রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে। তাই এঙ্গেলস বলেছেন, শ্রেণিগত বৈষম্যের কারণে শক্তির প্রতীক হিসেবে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর ভাষায়, পশুশক্তির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র নামক সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে (“The State became a necessity, because of this cleavage”) মার্কসীয় ধারণা অনুসারে, রাষ্ট্র শ্রেণিশাসনের একটি সংস্থা, এক শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণিকে শােষণ করার যন্ত্রবিশেষ।

(২) রাষ্ট্র শ্রেণিশােষণের হাতিয়ার: রাষ্ট্র হল শ্রেণিস্বার্থের ধারক ও বাহক এবং কেন্দ্রীভূত পশুশক্তির বহিঃপ্রকাশ। রাষ্ট্র হল একটি শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণিকে শাসন ও শোষণের যন্ত্র বিশেষ। লেনিনের মতে, রাষ্ট্র হল সামঞ্জস্যহীন শ্রেণিস্বার্থের একটি প্রকাশ। বলা যায় যে, রাষ্ট্র বিত্তবান শ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং শােষণপীড়নে ব্যবহৃত হয়েছে। রাষ্ট্র হল বল প্রয়োগমূলক হাতিয়ার যা শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সম্পত্তির মালিকানার নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়ােজনে প্রযুক্ত হয়। সমাজে প্রভুত্বকারী শ্রেণি রাষ্ট্রের আইন, প্রশাসন, বিচারালয়, সৈন্যবাহিনী, এমনকি সংখ্যালঘু শ্রেণিকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগায় এই রাষ্ট্র স্বরূপ হাতিয়ারের সাহায্যে। বলাবাহুল্য, সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণি রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে সম্পত্তিহীন শ্রেণিকে শােষণ করে। কার্ল মার্কস বলেছেন, রাষ্ট্র হল বুর্জোয়াদের কাজকর্ম দেখাশােনার জন্য একটি কার্যকরী কমিটি বিশেষ।

(৩) বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র: কার্ল মার্কস লিখেছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে শােষণ ও তাকে কেন্দ্র করে শােষক ও শােষিতের সংগ্রাম বহুদিন থেকে চলে আসছে। তার কথায়, মানব সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস The history of all hitherto existing society is the history of class-struggle”)I এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কার্ল মার্কস বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও ভূমিকা বিশ্লেষণ করেছেন। মার্কস, এঙ্গেলস সমাজ বিকাশের ৫টি পর্যায়ের কথা বলেছেন, যথা一

  • (a) আদি সাম্যবাদী সমাজ,
  • (b) দাস সমাজ,
  • (c) সামন্ততান্ত্রিক সমাজ,
  • (d) ধনতান্ত্রিক সমাজ এবং
  • (e) সমাজতান্ত্রিক সমাজ।

  • আদি সাম্যবাদী সমাজ: মানবসমাজ বিকাশের প্রথম স্তর আদি সাম্যবাদী সমাজের মূল কথা সাম্য। তখন সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণানাথাকায়সমাজ শ্রেণিবিভক্তছিলনা এবং সমাজ ছিল সম্পূর্ণরূপে শ্রেণিশােষণ মুক্ত। সুতরাং আদি সাম্যবাদী সমাজে রাষ্ট্র নামক শ্রেণিশােষণরূপ যন্ত্রেরও কোনাে অস্তিত্ব ছিল না।
  • দাস সমাজ: শ্রেণি বিভক্ত ও শ্রেণিশাসিত সমাজের প্রথম অধ্যায় হল দাস সমাজ, যা শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থার রূপ লাভ করে। এই সমাজব্যবস্থা দাস-মালিক ক্রীতদাস —এই দুই পরস্পর বিরোধী শ্রেণিতে বিভাজিত হয়। ক্রীতদাসরা দাস-মালিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। বলাবাহুল্য, ক্রীতদাসদের শােষণ করার জন্য রাষ্ট্ররূপ যন্ত্রের উৎপত্তি ঘটে এই দাস সমাজব্যবস্থায়। এই শােষণরূপ রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমেই সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা দাস-মালিকরা ক্রীতদাসদের প্রতি দমন ও শোষণ মূলক অত্যাচার করতে থাকে। এ কথা বলা যেতে পারে যে, দাস সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রূপ শােষণযন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যই ছিল দাসদের শােষণ করা।
  • সামন্ততান্ত্রিক সমাজ: সামন্ত সমাজ প্রকৃতিগত দিক থেকে আলাদা হলেও উদ্দেশ্যগত দিক থেকে দাস সমাজের থেকে আলাদা ছিল না। এই সমাজ সামন্তপ্রভু ও ভূমিদাস এই দুই পরস্পরবিরােধী শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। সামন্তপ্রভুরা উৎপাদনের উপাদানগুলিকে নিজেদের কুক্ষিগত রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক ও ভূমিদাসদের শােষণের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র শাসনযন্ত্রের আইন কানুনকে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় ব্যবহার করত। বলা যেতে পারে যে, ভূমিদাসদের উপর প্রভুত্ব বজায় রাখার তাগিদেই সামন্তপ্রভুরা রাষ্ট্রূপ শােষণযন্ত্রকে প্রয়ােগ করে তাদের শােষণকার্য ধারাবাহিকভাবে বজায় রেখে চলত।
  • পুঁজিবাদী সমাজ: শিল্পবিপ্লবের পর পুঁজিবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। উৎপাদনের উপকরণগুলির মালিকানা মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের হাতে চলে যায়। শ্রমিক শ্রেণির হাতে থাকে শুধু তাদের শ্রমশক্তি, এই সর্বহারা শ্রেণির উপর শাসন ও প্রভাব কায়েম করতে এবং শােষণ চালাতে পুঁজিপতিরা রাষ্ট্র শােষণযন্ত্র ব্যবহার করে। মালিক শ্রেণি শ্রমিক কর্তৃক উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে। শ্রমিকদের তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে, ফলে শ্রমিক অসন্তোষ জন্ম নেয়। এইভাবে সর্বহারা শ্রেণি সংগঠিত হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণির কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করে ধনতান্ত্রিক সমাজের পতন ঘটায়।
  • সমাজতান্ত্রিক সমাজ: শ্রমিকদের অসন্তোষ বা ক্ষোভের পরিণতিস্বরূপ উদ্ভূত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে থাকে। এর দরুন তাদের মধ্যে সর্বহারা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা লুপ্ত হয়ে সামাজিক মালিকানা বলবৎ হয়। এর ফলস্বরূপ মানুষের দ্বারা মানুষের শােষণের পরিসমাপ্তি ঘটে।

(৪) রাষ্ট্রের অবলুপ্তি: শোষণের যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের প্রয়ােজন ফুরিয়ে যাবে যদি সমাজতান্ত্রিক সমাজে শােষণের অবসান ঘটে। এর ফলে রাষ্ট্রের অবলুপ্তি ঘটবে (The state in wither away) এবং এরপর গড়ে উঠবে শ্রেণীহীন-শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ। এই সাম্যবাদী সমাজের মূলনীতি হবে প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে এবং প্রয়ােজন অনুযায়ী ভােগ করবে (“ From each according to his ability, to each according to his need”)।

রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসের তত্ত্বের সমালোচনা

রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বকে বিভিন্ন দিক থেকে সমালােচনা করা হয়েছে一

প্রথমত: মার্কসবাদ সমাজ বিবর্তনের কারণ হিসেবে অর্থনীতির উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ায় রাজনীতি উপেক্ষিত হয়েছে। কিন্তু সমাজ বিবর্তনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়া ধর্ম, নৈতিকতা, আদর্শ, কলা-কৃষ্টি প্রভৃতির প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।

দ্বিতীয়ত: মার্কসীয় তত্ত্বে সহিংস বিপ্লবকে স্বীকৃতি দিয়ে বহু ক্ষয়ক্ষতি ও রক্তপাতের সূচনা করা হয়েছে। কিন্তু এসব ছাড়াও মানুষের প্রেম প্রীতি, স্নেহ-ভালােবাসা আছে তা এখানে উপেক্ষিত।

তৃতীয়ত: মার্কসীয় তত্ত্বের রাষ্ট্র শুধুমাত্র শ্রেণিশােষণের যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় রাষ্ট্রের প্রজাকল্যাণমূলক কাজ এখানে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।

চতুর্থত: মার্কসীয় তত্ত্বে শ্রেণিসংগ্রামে সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সমালােচকগণের মতে, সর্বহারার জয়লাভের পর সেখানে এক নতুন সুবিধাভােগী শ্রেণির সৃষ্টি হবে।

পঞমত: কিছু সমালোচক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেন যে, কার্ল মার্কসের রাষ্ট্রের বিলুপ্তির তত্ত্ব ভ্রান্ত। সমালােচকদের মধ্যে সমাজতন্ত্রের পরে তিনি যে রাষ্ট্রহীন সমাজের কথা বলেছেন তা কাল্পনিক তত্ত্ব। রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দীর্ঘকালব্যাপী সমাজতন্ত্রের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের অবলুপ্তি ঘটেনি।

মূল্যায়ন: উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তা রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বের বিরুদ্ধ মত পোষণ করেছেন। তথাপি রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও প্রকৃতি বিষয়ক মতবাদগুলির মধ্যে শুধুমাত্র মার্কসবাদ বিজ্ঞান নির্ভর বলে মার্কসবাদীরা মনে করেন। সমাজ পরিবর্তনের জন্য মার্কসী রাষ্ট্রতত্ত্ব যে পথের দিশারি তা সত্যি ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন। তাই বলা যেতে পারে, রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণা যেমন সত্য ছিল, সত্য আছে, তেমনি ভবিষ্যতেও থাকবে।