আমলাতন্ত্র: শব্দগত বিচারে আমলাতন্ত্র বা ইংরেজি ‘Bureaucracy’ শব্দটি ফরাসি শব্দ ব্যুরাে’ (Bureau) এবং গ্রিক শব্দ ক্রেটিন (Kratein)-এর সমাহার। লেখার টেবিল বা ডেস্ক অর্থে ব্যুরাে এবং শাসন অর্থে ক্লেটিন শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তাই ব্যুৎপত্তিগত অর্থে আমলাতন্ত্র বলতে বােঝায় টেবিলে বসে পরিচালিত সরকার বা শাসন ব্যবস্থাকে (Desk-government)I
আমলাতন্ত্রের সংজ্ঞা: প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আধুনিক শাসন ব্যবস্থায় সরকারের রাজনৈতিক অংশ বা স্থায়ী অংশ, মূলত অভিজ্ঞ, বেতনভুক কর্মচারীবৃন্দ অর্থাৎ আমলাদের দ্বারা পরিচালিত হয়। এই পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা আমলাতন্ত্র নামে পরিচিত। এককথায় বলা যায়, সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে গড়ে ওঠা একটি সংগঠন বা গােষ্ঠীবিশেষ হল আমলাতন্ত্র। অধ্যাপক ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর ‘Essays in Sociology’ গ্রন্থে আমলাতন্ত্র সম্পর্কে বলেছেন, আমলাতন্ত্র হল প্রশাসনের একটি ব্যবস্থা, যার বৈশিষ্ট্য দক্ষতা, অপক্ষপাতিত্ব এবং মানবিকতার অনুপস্থিতি (“Bureaucracy is a system of administration characterised by expertness, impartiality and the absense of humanity.”)। অ্যালমন্ড ও পাওয়েলের অভিমত অনুযায়ী, আমলাতন্ত্র হল প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত এমন একটি সংগঠন, যে সংগঠনে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ পরস্পরের সঙ্গে সর্বদাই যুক্ত হয়ে থাকে।
[1] স্থায়িত্ব: আমলাতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল তাদের পদের বা চাকরির স্থায়িত্ব। বিভিন্ন শর্ত ও নিয়ম মেনে তারা নিযুক্ত হন এবং নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সেই পদে বহাল থাকতে পারেন, যদি না অসাংবিধানিক কাজকর্মের অভিযােগে বরখাস্ত হন। যাইহােক, এককথায় আমলাতন্ত্র হল স্থায়ী প্রশাসকমণ্ডলী।
[2] নিরপেক্ষতা: আধুনিক শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলেও তাদের মতাদর্শ ও কর্মসূচি একরকম নয়। আমলাবাহিনী বা সরকারি কর্মচারীদের সবসময় নিরপেক্ষতা অবলম্বন করতে হয়, যাতে দলীয় মতাদর্শ ও কর্মসূচি প্রশাসনকে কোনােভাবে কলুষিত বা ক্ষতিগ্রস্তকরতে না পারে। এর জন্য যে রাজনৈতিক দলই শাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হােক-না-কেন আমলারা সেই দলীয় সরকারের অন্তর্ভুক্ত থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকেন। বলাবাহুল্য, আমলারা সব সমাজ ব্যবস্থায় রাজনীতি নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। অবশ্য মার্কসবাদীদের মতে, আমলারা যে-কোনাে শােষণমূলক সমাজ ব্যবস্থায় কায়েমি স্বার্থের সংরক্ষক হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকেন।
[3] পরিবর্তনশীলতা বা নমনীয়তা: আমলাদের দলনিরপেক্ষভাবে কার্য সম্পাদন করতে হয়, কোনাে বিশেষ নীতির প্রতি তাদের আনুগত্য পােষণ করা উচিত নয়। এর জন্যই তাদেরকে পরিবর্তনশীল বা নমনীয় মানসিকতার অধিকারী হতে হয়। নমনীয় বা পরিবর্তনশীল মানসিকতা নিয়ে কাজ করা আমলাতন্ত্রের একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। আমলাদেরকে দল নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হয় আবার বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষমতাসীন দলের কাজকর্মের সঙ্গে নিজেদেরকে সংযুক্ত করতে হয়।
[4] প্রশাসনের নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখা: গণতন্ত্রে সরকারের পরিবর্তন ঘটতেই পারে, এমন হলে তখন সরকারের স্থায়ী কর্মচারী হিসেবে আমলাতন্ত্রের প্রশাসনের কাজকর্মের গতি, সচলতা ও নিরবচ্ছিন্নতা বজায় থাকে। প্রতিনিধিত্বমূলক দলীয় শাসন সরকারের রূপ পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্নতা রক্ষার গুরু দায়িত্ব আমলারা পালন করে থাকেন।
[5] দায়িত্বশীলতা: আমলাদের কাজকর্মের কোনাে দায়বদ্ধতা নেই এমন নয়, তারা তাদের কাজকর্মের জন্য প্রত্যেক বিভাগীয় মন্ত্রক বা মন্ত্রীর কাছে সমানভাবে দায়বদ্ধ থাকেন। তাই দায়িত্বশীলতাও হল আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
[6] শৃঙ্খলাবােধ: আমলাতন্ত্রকে কঠোর শৃঙ্খলাবােধ মেনে কাজ করতে হয়। সরকারি নীতিকে বাস্তবায়িত করার জন্য শৃঙ্খলাবোধ অপরিহার্য, প্রয়ােজনে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ পর্যন্ত করা হয়ে থাকে।
[7] লােকচক্ষুর অন্তরালে থাকেন: আমলাবাহিনী সরকারের হয়ে সকলরকম কাজকর্ম করেন। তবে সরকারি কাজের সুনাম বা দুর্নামের ভাগীদার তারা হন না, সরকারের সাফল্য-অসাফল্যের যাবতীয় সুনাম ও দুর্নাম মন্ত্রীরা ভােগ করেন। সরকারি কর্মচারীগণ বা আমলাগণ সবসময় লােকচক্ষুর অন্তরালে বা অজ্ঞাতনামা থাকেন।
[8] নিয়মানুবর্তিতা: কঠোর নিয়মানুবর্তিতা অনুসরণ আমলাতন্ত্রের একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের কাজকর্ম ও কাজকর্মের মধ্যে সমন্বয়সাধনের জন্য নিয়মানুবর্তিতা পালন অপরিহার্য। আমলারা নিজেদেরকে প্রশাসনিক কাজকর্মের মধ্যে আত্মনিয়ােগ করে রাখেন যাতে সর্বসাধারণের সর্বাধিক কল্যাণসাধন করা সম্ভব হয়।
[9] স্তরবিন্যাস: আমলাতন্ত্রে স্তরবিন্যস্ত কর্মচারীদের মধ্যে পিরামিডের মতাে কাঠামােবিন্যাস পরিলক্ষিত হয়। এইরকম কাঠামােই বর্তমান আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচিত হয়। এই পিরামিড কাঠামাের মধ্যেই সুনির্দিষ্ট থাকে কোন শ্রেণির আমলারা কী কী কাজ এই শাসন ব্যবস্থায় থেকে সম্পাদন করবে। আমলাদের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থেকেই কার্যকলাপ সম্পূর্ণ করতে হয়।
[10] রুটিনমাফিক কাজকর্ম: সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট বিধি-নীতির দ্বারা আমলাতন্ত্র পরিচালিত হয়। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য আমলাতন্ত্রের কাজকর্মকে একটি নির্দিষ্ট রুটিনের মধ্যে বেঁধে দেওয়া হয়। এর জন্যই শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে আমলাদের কোনােরকম বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় না।
[11] নিয়ােগ, কার্যকাল, পদোন্নতি: সাধারণ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা-পদ্ধতি মাধ্যমে সরকারি আমলাবাহিনীর নিয়ােগ ও কার্যকাল নির্ধারিত হয়। কাজের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ এবং সিনিয়রিটির ভিত্তিতে তাদের পদোন্নতি হয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষা-পদ্ধতির পরিবর্তে বিশেষ প্রশিক্ষণ, শিক্ষাগত যােগ্যতা, অভিজ্ঞতা প্রভৃতির উপর বেশি জোর দেওয়া হয়ে থাকে।
একক পরিচালক ও বহুপরিচালকবিশিষ্ট শাসন বিভাগের সুবিধা-অসুবিধাগুলি আলােচনা করাে।
নামসর্বস্ব শাসক আর প্রকৃত শাসকের মধ্যে পার্থক্য । আধুনিক রাষ্ট্রের শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ
রাষ্ট্রের শাসন বিভাগের মূল কাজ । আধুনিক রাষ্ট্রের শাসন বিভাগের কার্যাবলি
Leave a comment