ভূমিকা: ভারতবর্ষ হল বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতবর্ষ হল একটি ধনী-গরিব দেশ এবং সবল-দুর্বল রাষ্ট্র (India is a rich poor Nation & weak strong State)I ইংল্যান্ডের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার অনুকরণে ভারতের সংবিধান-প্রণেতাগণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার ও শাসন বিভাগ পরিচালনার নীতি গ্রহণ করেছেন। ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ক্যাবিনেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। ক্যাবিনেট বা মন্ত্রীপরিষদকে বলা হয় ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর (The keystone of the Political System)। ভারতীয় সংবিধানের ৭৪নং ধারায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদ বা মন্ত্রীসভা গঠনের কথা বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী-সহ বিভিন্ন স্তরের মন্ত্রীদের নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হলেন ক্যাবিনেট এবং সমগ্র মন্ত্রীসভার অবিসংবাদিত নেতা। সংবিধানের ৭৪(১) নং ধারায় বলা হয়েছে যে, Council of Minister at the head to aid and advise President। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির কার্যাবলি সম্পাদনে সাহায্য এবং পরামর্শদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রীসভা থাকবে। এরূপ শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রকৃত শাসকপ্রধান (Real Head) এবং রাষ্ট্রপতি হলেন নামসর্বস্ব শাসকপ্রধান (Nominal Head)।
সাংবিধানিক রীতি: সাংবিধানিক রীতি অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটের নেতাকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে মন্ত্রী পরিষদের অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়ােগ করেন। তবে কোনাে দল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রপতি স্ববিবেচনামূলক বিশেষ ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন।
মন্ত্রী নিয়ােগের শর্তাবলি: মন্ত্রী নিয়োগের শর্ত হল যাকে রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণ করাবেন তিনি লোকসভা ও রাজ্যসভা যে-কোনাে একটি কক্ষের সদস্য হবেন। আর তিনি যদি কোনাে কক্ষের নির্বাচিত বা মনােনীত সদস্য না হন তাহলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর ৬ মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের যে-কোনাে কক্ষের সদস্য হিসেবে তাকে নির্বাচিত হতে হবে। (1) লোকসভা বা রাজ্যসভা যে-কোনাে একটি কক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচিত করা হয়। (2) প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ছিলেন রাজ্যসভার এমপি। এ ছাড়াও ইন্দিরা গান্ধি, আই কে গুজরাল প্রমুখ রাজ্যসভার এমপি ছিলেন। (3) বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামােদর দাস মোদি লোকসভার সদস্য। (4) আবার কোনাে কক্ষের সদস্য না হয়েও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর তার পুত্র রাজিব গান্ধি প্রধানমন্ত্রী হন। তারপর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনি নির্দিষ্ট আসন থেকে ভোটে জিতে সংসদ-সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
ভারতের কেন্দ্রীয় শাসন বিভাগ রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী-সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত। সংবিধানে মন্ত্রীপরিষদ বা মন্ত্রীসভা গঠন, সদস্য সংখ্যা এবং মন্ত্রীসভার শ্রেণি বিভাজন সম্পর্কে তেমন কোনাে বক্তব্য পাওয়া যায় না। তবে প্রশাসনিক সংস্কার কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে লোকসভার মােট সদস্য সংখ্যার শতকরা দশ শতাংশ হবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদের সদস্য সংখ্যা। ভারতেও গ্রেট ব্রিটেনের মতাে তিন ধরনের মন্ত্রী দেখা যায়। যথাㅡ
- ক্যাবিনেট মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী: সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব থাকে ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের উপর।
- স্বাধীন রাষ্ট্রমন্ত্রী: অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলির দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে এই মন্ত্রীদের উপর।
- উপররাষ্ট্রমন্ত্রী: উপমন্ত্রী গণ বিভাগীয় কাজকর্মে সাহায্য করে থাকেন।
সংবিধান অনুসারে মন্ত্রীদের কার্যকলাপের মেয়াদ রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির উপর নির্ভরশীল হলেও বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর আস্থা এবং যৌথভাবে লোকসভার আস্থার উপর নির্ভরশীল।
ক্যাবিনেট: ক্যাবিনেট হল মন্ত্রীসভার একটি ক্ষুদ্র অংশ। সংবিধানে ক্যাবিনেট শব্দটির উল্লেখ ছিল না। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৪৪তম সংবিধান-সংশােধনী আইন দ্বারা ৩৫২ নং ধারায় সর্বপ্রথম ক্যাবিনেট কথাটি অন্তর্ভুক্ত হয়। সাধারণত ক্যাবিনেটের সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন হয়ে থাকে। ক্যাবিনেট সদস্যগণ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন।
কিচেন ক্যাবিনেট: ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দপ্তরের মন্ত্রীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি অতি ক্ষুদ্র সংস্থা থাকে, তাকে বলা হয় কিচেন ক্যাবিনেট (Kitchen Cabinet)। অনেকে একে অভ্যন্তরীণ বা সুপার ক্যাবিনেটও বলে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে কখনােই সম্ভব হয় না ক্যাবিনেটের সকল সদস্যের সঙ্গে পরামর্শ করে ক্যাবিনেটের কোনাে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। এই কারণেই প্রধানমন্ত্রী একান্ত বিশ্বাসভাজন ৩/৪ জন বিশিষ্ট কেবিনেট মন্ত্রীবর্গকে নিয়ে কিচেন ক্যাবিনেট গঠন করে থাকেন। কিচেন ক্যাবিনেটের মাধ্যমেই কেন্দ্রীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকে।
তত্ত্বগতভাবে ভারতের রাষ্ট্রপতির হাতে যেসকল ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে বাস্তবে সেই সকল ক্ষমতাকেই প্রয়ােগ করে মন্ত্রীসভা। মন্ত্রীসভা যেসকল কাজ সম্পাদন করে সেগুলি হল নিম্নরূপㅡ
(১) সরকারের নীতি নির্ধারণ করা: সরকারের কাজকর্ম খেয়ালখুশির দ্বারা পরিচালিত হয় না, তার পেছনে থাকে কিছু সুস্পষ্ট নীতি নির্দেশ। কী ধরনের এবং কোন কোন নীতির দ্বারা পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করা মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মন্ত্রীসভা মূলত সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করে থাকে এবং সেইসব নীতিকে সংসদে অনুমােদন লাভ করিয়ে রূপায়ণ করার দায়িত্ব পালন করে থাকে।
(২) বিলের খসড়া তৈরি এবং পার্লামেন্টে তা উপস্থাপন করা: মন্ত্রীসভা তার কাজকর্ম সম্পাদনের যে নির্দেশক নীতি গ্রহণ করে, কর্মের মধ্যে ঘটে তার রূপায়ণ। তার জন্য প্রয়ােজন অনুকূল আইন প্রণয়নের। তার খসড়া প্রস্তুত করা ও বিলের আকারে তা পার্লামেন্টে উত্থাপন করা মন্ত্রীসভার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে বিবেচিত হয়। পার্লামেন্টে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তারা সরকার গঠনের অধিকার পায়, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই তারা আইন প্রণয়নের কার্যকেও নিজেদের অনুকূলে প্রভাবিত করতে পারে।
(৩) বাজেট তৈরি করা ও অনুমােদনের জন্য তা পার্লামেন্টে পেশ করা: ভারতের পার্লামেন্ট হল জাতীয় তহবিলের (Consolidated Fund of India) রক্ষক। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য যে বাৎসরিক অর্থের প্রয়ােজন হয় তার জন্য সরকার পার্লামেন্টের কাছ থেকে আগাম ব্যয় অনুমােদন করিয়ে নিতে হয়। এ ছাড়া সঞ্চিত তহবিলের অর্থ জোগান যাতে অব্যাহত থাকে তা দেখার দায়িত্বও সরকারের উপর ন্যস্ত হয়, সেইজন্য প্রতি বছর সরকারের সম্ভাব্য আয় ব্যয়ের একটি খসড়া প্রস্তুত করতে হয়।
(৪) পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইন কার্যকরী করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা: পার্লামেন্ট যে আইন প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। আইন বাস্তবায়িত করতে গিয়ে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার তা সরকারের পক্ষে মন্ত্রীসভাই গ্রহণ করে থাকে। প্রয়ােজনীয় সমস্ত আইন প্রণয়ন করা অনেকসময় পার্লামেন্টের হাতে থাকে না। সেইসব ক্ষেত্রে পার্লামেন্ট আইনের মােটামুটি একটি কাঠামাে ঠিক করে দেয়, আর সরকারের শাসন বিভাগ সেই কাঠামাের মধ্য থেকে আইনকে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করে। যদিও নিয়ম, নির্দেশ, সংকটকালীন ব্যবস্থা (ordinance) ইত্যাদির মাধ্যমে তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রপতি এই কার্য পরিচালনা করলেও বাস্তবে কিন্তু এই কাজ মন্ত্রীসভাই করে থাকে।
(৫) স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার রূপরেখা প্রস্তুত করা: কাজকর্মের মধ্য দিয়ে নানাবিধ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অগ্রগতি সূচিত করাই হল সরকারের উদ্দেশ্য। এর জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারকে বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়। এইসব পরিকল্পনার রূপরেখা প্রস্তুত করা, সেগুলিকে পার্লামেন্টে অনুমােদন করিয়ে নেওয়া এবং বাস্তবে রূপায়িত করার উদ্যোগ মন্ত্রীসভাকেই গ্রহণ করতে হয়।
(৬) নিয়োগ সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ করা: ভারতে যত গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ আছে যথা রাজ্যপাল, রাষ্ট্রদূত, প্রধান বিচারপতি, রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের সদস্য, সামরিক বাহিনীর প্রধানগণ প্রমুখের নিয়ােগের ক্ষেত্রে তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা থাকলেও বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।
(৭) বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সংহতি সাধন করা: মন্ত্রীপরিষদ বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে। প্রশাসনকে সুষ্ঠু নীতিতে পরিচলনা করতে হলে বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি এই সমন্বয়সাধনের কাজটি মন্ত্রক তার সচিবালয়ের সাহায্যে সম্পাদন করে থাকে।
(৮) বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল ভারতের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ ও প্রয়ােগ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর হল পররাষ্ট্র দপ্তর। প্রধানমন্ত্রী হবেন পররাষ্ট্র নীতি তথা বৈদেশিক নীতির প্রধান রূপকার। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক খনিজ বা চুক্তি সম্পাদন, যুদ্ধ বা শাস্তি ঘােষণা প্রভৃতির দায়িত্ব কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা সক্রিয়ভাবে পালন করে।
(৯) প্রশাসনিক দায়িত্ব: কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শাসন বিভাগ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। মন্ত্রীদের নির্দেশ অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীগণ শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ক্যাবিনেটের লিখিত সুপারিশ ছাড়া রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘােষণা করতে পারেন না। পার্লামেন্টের প্রধান আইন গুলো যথাযথ ভাবে কার্যকরী করতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সভায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে।
(১০) জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রকৃত প্রস্তাবে জরুরি অবস্থা বা অঙ্গরাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘােষণার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটি।
উপসংহার: দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে যে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা কার্যক্ষেত্রে ক্যাবিনেটই ভােগ করে। ক্যাবিনেট সংসদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও শাসন বিভাগের সংযােগ রক্ষা করে থাকে। ক্যাবিনেটের প্রকৃত ক্ষমতার কথা মাথায় রেখে অধ্যাপকআর এন আগরওয়াল বলেছেন, ক্যাবিনেট হল দেশের প্রকৃত কার্যনির্বাহক। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আসলে ক্যাবিনেটেরই ক্ষমতা (“The Cabinet is the real executive of the land. The powers of the President are in reality, the powers of the Cabinet.”)।
Leave a comment