ভূমিকা: ভারতের সংবিধানে কেন্দ্রীয় শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ পদাধিকারী হলেন রাষ্ট্রপতি। সংবিধানের ৫৩নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি তার শাসন সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা সংবিধান অনুসারে প্রয়ােগ করতে বাধ্য এবং সংবিধানের ৭৪ নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি একটি মন্ত্রীসভা গঠন করতে বাধ্য। তিনি হলেন নিয়মতান্ত্রিক শাসকপ্রধান। ড. বাবা সাহেব আম্বেদকরের মতে, তিনি রাষ্ট্রের প্রধান কিন্তু কার্যনির্বাহকদের প্রধান নন। তিনি জাতির প্রতিনিধি কিন্তু শাসক নন (“He is the head of the state, but not of the executive. He represents the Nation, but does not rule the Nation.”)। অন্যদিকে ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ব্যক্তি হলেন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধানের ৭৪(১) নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতির প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে যে মন্ত্রীসভা থাকে, প্রধানমন্ত্রী হলেন তার নেতা। তিনি হলেন প্রকৃত শাসকপ্রধান।

ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ককে প্রধানত দুটি দিক থেকে আলােচনা করা উচিত। প্রথমত, সংবিধানে উভয়ের সম্পর্কের বিষয়ে আলােচনা করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, বাস্তবে তাদের উভয়ের কাজের সূত্রে যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার পর্যালােচনা এবং মূল্যায়নের মাধ্যমে ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক আলােচনা করা যেতে পারে।

সংবিধানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক

ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন ইংল্যান্ডের রাজা বা রানির মতাে নিয়মতান্ত্রিক শাসকপ্রধান। তাকে শাসন বিভাগের আলংকারিক প্রধানে পরিণত করাই ছিল সংবিধান-প্রণেতাদের লক্ষ্য। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন শাসনবিভাগের প্রকৃত শাসকপ্রধান। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসন কার্য পরিচালনা করতে বাধ্য থাকেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কের দিকগুলি নিম্নে আলােচনা করা হল –

(১) নিয়ােগ সংক্রান্ত সম্পর্ক: সংবিধানের ৭৫ (১) ও (৩) নং ধারায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন, মন্ত্রীগণ সমষ্টিগতভাবে তাদের কার্যাবলির জন্য লােকসভার নিকট দায়ী থাকবে। উপরিলিখিত ধারা দুটির মধ্যে আপাত বিরোধিতা তৈরি হয়, যা কার্যকর বিধির মাধ্যমে অপসারিত হয়। আবার লোকসভায় যদি কেউ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হন, তাহলে রাষ্ট্রপতি তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােগ করতে পারেন। কিন্তু লোকসভায় যদি কোনাে দল বা জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি তার ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচন করে থাকতে পারেন। ৭৫ (২) নং ধারা অনুযায়ী মন্ত্রী কে রাষ্ট্রপতি নিয়ােগ করতে পারেন কিন্তু এই নিয়ােগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চলতে হয়।

(২) সম্মতি প্রদানের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৪২তম সংশােধনীতে বলা হয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার কোনাে বিলে সম্মতি দিতে বাধ্য। তবে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৪৪তম সংশােধনীতে ৭৪(১) নং ধারার সংশােধন করে বলা হয় যে, মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুসারে রাষ্ট্রপতি চলবেন তবে প্রদত্ত পরামর্শ পুনর্বিবেচনা করার জন্য রাষ্ট্রপতি একবার হলেও মন্ত্রীসভাকে অনুরােধ করতে পারেন। তবে রাষ্ট্রপতি সেই অনুরােধ অনুসারে চলতে পারেন আবার নাও চলতে পারেন। যেমন— প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর সময় নির্বাচন কমিশনের একটি নির্দেশ (নির্বাচনে আবেদনকারী প্রার্থীর এফিডেভিট সংক্রান্ত) বাতিল করা সম্পর্কিত একটি বিল বাজপেয়ী সরকার রাষ্ট্রপতি আব্দুল কালামের কাছে পাঠালে তিনি পুনর্বিবেচনার জন্য বিলটিকে ফেরত পাঠান। বাজপেয়ীর মন্ত্রীসভা সেই বিলটিকে পুনরায় পাঠালে রাষ্ট্রপতি সেই বিলে অনুমােদনসূচক স্বাক্ষর প্রদান করে থাকেন।

(৩) রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীসভার যােগসূত্র হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: সংবিধানের ৭৮নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মন্ত্রীসভার যােগসাধনের ভূমিকা পালন করেন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধানের ৭৮নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, মন্ত্রীপরিষদের যাবতীয় সিদ্ধান্ত, কেন্দ্রের শাসন সংক্রান্ত যাবতীয় সংবাদ, আইনের প্রস্তাবসমূহ রাষ্ট্রপতিকে জানানাে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং বলেছিলেন যে, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক যে-কোনাে তথ্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযােগসুবিধা রাষ্ট্রপতির আছে। এ ছাড়াও রাষ্ট্রপতি কোনাে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকে মন্ত্রীপরীষদ কর্তৃক বিবেচনা করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে পারেন।

(৪) সাংবিধানিক দায়িত্ব সম্পাদনের ক্ষেত্রে উভয়ের ভূমিকা: সাংবিধানিক দায়িত্ব সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ভারতের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে রাষ্ট্রপতির দ্বারা প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ কে দিয়ে জওহরলাল নেহরু, সঞ্জীব রেড্ডি দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী কে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছে; তবে উভয় ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা ও জনপ্রিয়তা রাষ্ট্রপতির উপর প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু এটাও সত্যি যে, লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া রাষ্ট্রপতির উপর প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই ও চরণ সিং-এর সময় রাষ্ট্রপতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল।

(৫) প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির বাস্তব কার্যকারণ সম্পর্ক: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কার্যকারণগত সম্পর্ক সবসময় একই ধারায় অতিবাহিত হয়নি। প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরু ও প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনার মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ড. রাধাকৃয়াণও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন না। চিনের সঙ্গে সীমান্ত-বিরােধকে কেন্দ্র করে নেহরু এবং তাঁর মধ্যে মতবিরােধ তৈরি হয়েছিল। ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি তিনজন প্রধানমন্ত্রীর (মোরারজি দেশাই, চরণ সিং এবং ইন্দিরা গান্ধি) সঙ্গে কাজ করতে হয়েছিল, তিনি কোনাে অবস্থাতেই নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেননি। সপ্তম রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং-এর সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের স্বর্ণ মন্দিরে সেনাবাহিনীর প্রবেশ নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল। তবে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির মধ্যে তেমন কোনাে সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়নি।

উপসংহার: কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি নিজ নিজ মতামত ব্যক্ত করলেও বা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর মতের বিভিন্নতা দেখা দিলেও কোনােভাবেই কোনাে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে অগ্রাহ্য করেননি। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কার্যত প্রধানমন্ত্রীর উত্থান এবং রাষ্ট্রপতির অবনয়ন (Decline) হল সাম্প্রতিককালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাষ্ট্রপতির সক্রিয়তা বা নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে যা বলা হােক-না কেন, কোনাে রাষ্ট্রপতি চূড়ান্তভাবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব অস্বীকার করেননি। বলাবাহুল্য, অনেক রাষ্ট্রপতি অনিচ্ছা সত্ত্বেও কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব মেনে নিয়েই কাজ করে থাকেন।

একটি উদাহরণ দেওয়া যায় যে, প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই পদত্যাগ করলে চরণ সিং এবং জগজীবন রামের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে বিরােধ দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি নিজ ক্ষমতাবলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা সত্ত্বেও চরণ সিং-কে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােগ করেছিলেন। তবে এইসব ব্যতিক্রম সংসদীয় গণতন্ত্রে বিতর্কের সৃষ্টি করলেও চূড়ান্ত বিচারে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির তুলনায় অধিক ক্ষমতার অধিকারী বলেই বেশি মর্যাদালাভ করেছে।