ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রের মতাে রাজ্যগুলিতেও সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বা সরকার বর্তমান। অঙ্গরাজ্যের শাসন বিভাগ রাজ্যপাল এবং রাজ্য মন্ত্রীসভাকে নিয়ে গঠিত। সংবিধানের ১৫৪ (১) নং ধারা অনুযায়ী রাজ্যের শাসনক্ষমতা রাজ্যপালের হাতে ন্যস্ত, যদিও অনেকেই মনে করেন রাজ্যপাল একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসক হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেকে মনে করেন যে, রাজ্যপাল তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করে যে-কোনাে সময় রাজ্যের প্রকৃত শাসক হয়ে উঠতে পারেন। তিনি মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ অনায়াসেই অগ্রাহ্য করতে পারেন। বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ এস আর মাহেশ্বরী তার ‘State Governments in India’ গ্রন্থে বলেছেন, সংবিধানে উল্লিখিত সকল কার্যাবলির বিচারে রাজ্যপালের ক্ষমতা স্পষ্টতই সব থেকে বেশি (“of all the functions mentioned in the constitution, the Governor has clearly been the most Powerful.)। যেসকল সংবিধান-বিশারদ সংবিধানের বিভিন্ন ধারা বিশ্লেষণ করে মনে করেন যে, রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের প্রকৃত শাসক তাঁদের যুক্তিগুলি হল নিম্নরূপ一
(১) সাংবিধানিক অধিকর্তা: সংবিধানের ১৫৪ (১) নং ধারায় বলা হয়েছে যে, রাজ্যপাল নিজে বা তার অধস্তন কর্মচারীদের মাধ্যমে রাজ্যের শাসন ক্ষমতা সংবিধান সম্মতভাবে প্রয়ােগ করতে পারেন। সুতরাং সংবিধান অনুসারে রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের প্রকৃত শাসক।
(২) মন্ত্রীদের পরামর্শ গ্রহণে রাজ্যপালের বাধ্যবাধকতা নেই: সংবিধান অনুসারে রাজ্যপাল হলেন রাজ্যের শাসনকর্তা। প্রয়ােজনবােধে তিনি মন্ত্রীসভার পরামর্শ ও সাহায্য গ্রহণ করতে পারেন, আবার গ্রহণ করতে না পারে। ভারতীয় সংবিধানের ৪২তম সংবিধান-সংশোধনী আইন (১৯৭৬ খ্রি.) অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে কেন্দ্রীয় সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু রাজ্যে রাজ্যপালের শাসনকার্যে এরূপ কোনাে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা যায় না।
(৩) রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ: সংবিধানের ১৬৩(২) নং ধারায় বলা হয়েছে যে, স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগের ক্ষেত্রে রাজ্যপালকে রাজ্য মন্ত্রীসভার পরামর্শ গ্রহণ করতে হয় না। স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগের বৈধতা সম্পর্কে আদালতে কোনাে প্রশ্ন তােলা যায় না। এই ক্ষমতাবলে তিনি স্ববিবেচনা অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। এই কারণেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করে রাজ্যের প্রকৃত শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। সংবিধানে রাজ্যপালের কতকগুলি সুনির্দিষ্ট স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার উল্লেখ আছে। যেমন—মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগ ও অপসারণ, বিধানসভা ভেঙে দেওয়া, রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের জন্য বিল প্রেরণ করা ইত্যাদি।
(৪) রাষ্ট্রপতির প্রতি আনুগত্য: সংবিধানের ১৫৬ (১) নং ধারানুযায়ী, রাজ্যপালের কার্যকাল অনেকাংশে নির্ভরশীল রাষ্ট্রপতির সন্তুষ্টির উপর। দেখা যায় যে, রাজ্যপাল চাকরির শর্তের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন অর্থাৎ রাজ্যের রাজ্যপাল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। যেমন বিধানসভা বিল সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্ত না নিয়ে রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দিতে পারেন। আবার ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যপাল কেরল শিক্ষা বিলের ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী নাম্বুদ্রিপাদের অনুরােধ উপেক্ষা করেই রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের জন্য পাঠিয়ে দেন।
(৫) মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের নিযুক্তি: রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কিংবা অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়ােগের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন। রাজ্যপাল যদি দেখেন বিধানসভায় কোনাে দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ, তবে তিনি তার বিবেচনা অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগ করতে পারেন। যেমন ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ঝাড়খণ্ডে বিধানসভা নির্বাচনে কোনাে দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি, তখন রাজ্যপাল কংগ্রেস ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (JMM) জোটের নেতা শিবু সােরেনকে মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য আহ্বান জানান।
(৬) মন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত করা: অঙ্গরাজ্যের রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতির কাছে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রেরণ করে থাকেন। ৩৫৬ নং ধারানুসারে, রাজ্যপালের এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট রাজ্যে রাষ্ট্রপতি-শাসন বা রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জারি করতে পারেন। এইভাবে রাজ্যপাল বিধানসভার মন্ত্রিসভা কে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেন।
(৭) রাজ্য বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন আহ্বান, স্থগিত রাখা ও ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা: রাজ্যপালের বিশেষ ক্ষমতাগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযােগ্য ক্ষমতা হল বিধানসভার অধিবেশন আহ্বান করা। লক্ষ করা যায় যে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালের করা অনুরােধ সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য বিধানসভার অধিবেশন আহ্বানে যদি রাজি না হন তাহলেও রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন। যেমন— হরিয়ানার রাজ্যপাল তার এই ক্ষমতার প্রয়ােগ ঘটিয়েছেন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বীরেন্দ্র সিং-এর ক্ষেত্রে। তাকে তিনি আস্থা ভােটে শক্তি প্রদর্শনের সুযােগ করে দেননি। এ ছাড়াও রাজ্যপাল রাজ্য আইনসভার অধিবেশন স্থগিত রাখা এবং বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে মন্ত্রীসভার পরামর্শ গ্রহণ করে থাকেন।
(৮) রাষ্ট্রপতি-শাসন জারির সুপারিশ: সংবিধানের ৩৫৬ নং ধারা অনুসারে রাজ্যপাল সংশ্লিষ্ট রাজ্যের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে যে রিপাের্ট পেশ করেন, তাতে তিনি রাষ্ট্রপতি-শাসন জারির জন্য সুপারিশ করতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনি মন্ত্রীসভাকে না জানিয়েই সিদ্ধান্ত নেন। এর অনেক দৃষ্টান্ত ভারতবর্ষের অঙ্গরাজ্য গুলিতে দেখা গিয়েছিল। যেমন— ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার তদানীন্তন রাজ্যপাল রঘুনাথ রেড্ডির রিপাের্টের ভিত্তিতে সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়েছিল।
(৯) রাষ্ট্রপতির নিকট বিল পাঠানাে: রাজ্যপালের সম্মতি ছাড়া কোন রাজ্য বিল আইনে পরিণত হতে পারে না। অনেকসময় রাজ্যপাল রাজ্য আইনসভা কর্তৃক গৃহীত কোনাে বিলে নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দিতে পারেন (২০০ ও ২০১ নং ধারা)। উদাহরণ হিসেবে, শিল্প বিরােধ (পশ্চিমবঙ্গ সংশােধন) বিল ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে, ট্রেড ইউনিয়ন (পশ্চিমবঙ্গ সংশােধন) বিল ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে, পশ্চিমবঙ্গ গৃহ-পর্ষদ (সংশােধন) বিল ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়।
রাজ্যপালের পদমর্যাদা
রাজ্যপাল প্রকৃত শাসক। কিন্তু সময় এবং পরিস্থিতির দিকে একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখলেই বােঝা যাবে যে, সচরাচর তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরােধিতা করেননি। কেন্দ্র এবং রাজ্যে একই রাজনৈতিক দল বা জোট ক্ষমতাসীন থাকলে সেখানে সংসদীয় ব্যবস্থার রীতি অনুযায়ী রাজ্যপাল নিয়মতান্ত্রিক শাসকের ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু যে রাজ্যে কেন্দ্রবিরােধী কোনাে রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন, সেখানে রাজ্যপাল প্রকৃত শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভারতে অনেক রাজ্যপালের উপস্থিতি দেখা গেছে, যাঁরা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দুর্বল প্রকৃতির নন, তারা সংসদীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি অনুযায়ী, সংবিধানসম্মতভাবেই তার ক্ষমতা প্রয়ােগ করে থাকেন।
Leave a comment