ভূমিকা : মুখ্যমন্ত্রী হলেন রাজ্য ম্ত্রীপরিষদের নেতা। মন্ত্রীপরিষদে তাঁর স্থান সবার শীর্ষে। সংবিধানের ১৬৩ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, রাজ্যপাল কে সাহায্য ও সহযােগিতা করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রীপরিষদ থাকবে (Council of Ministers at the head to aid and advise Governor. Act 163)।

রাজ্য মন্ত্রীসভার গঠন

রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে যে দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে, সেই দল বা জোটের নেতা বা নেত্রীকে সংবিধান অনুসারে রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১৬৪ (১) নং ধারানুসারে, রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে অন্যান্য মনােনীত সদস্যদের মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করেন। মন্ত্রীসভার সদস্যদের রাজ্য আইনসভা অর্থাৎ রাজ্য বিধানসভার সদস্য হতে হয়। রাজ্যে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা থাকলে মন্ত্রীকে যে-কোনাে একটি কক্ষের সদস্য হতে হয়। কোনাে কক্ষের সদস্য নন এমন কেউ মন্ত্রী হলে তাকে আগামী ৬ মাসের মধ্যে (এককক্ষবিশিষ্ট রাজ্য আইনসভার ক্ষেত্রে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে) আইনসভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসতে হয়।

রাজ্য মন্ত্রীসভার নিয়ােগ: মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে মাননীয় রাজ্যপাল মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের নিয়ােগ করেন। তিনি মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বন্টন বা পুনর্বণ্টন করতে পারেন। রাজ্যপাল সংবিধানের ভঙ্গের অভিযােগে মন্ত্রীপরিষদকে বরখাস্ত করতে পারেন বা কোনাে মন্ত্রীকে পদচ্যুত করতে পারেন।

রাজ্য মন্ত্রীসভার শ্রেণিবিভাজন: রাজ্য মন্ত্রীসভায় তিন শ্রেণির মন্ত্রী থাকেন। যথা一

  • ক্যাবিনেট মন্ত্রী: সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্ব থাকে ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের উপর।
  • রাষ্ট্রমন্ত্রী: অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলির দায়িত্ব থাকে রাষ্ট্র মন্ত্রী গণের উপর।
  • উপরাষ্ট্রমন্ত্রী: উপমন্ত্রীগণ বিভাগীয় কাজকর্মে সহযােগিতা করে থাকেন।

মন্ত্রীদের দায়িত্বশীলতা: বিধানসভায় কোনাে একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রকাশ করলে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। আবার রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে কোনাে মন্ত্রীকে পদচ্যুত করতে পারেন। বিধানসভার কাছে মন্ত্রীদের প্রত্যেকের দায়িত্বশীলতা ছাড়াও সামগ্রিকভাবে মন্ত্রীসভার যৌথ দায়িত্বশীলতা থাকে।

কার্যকাল: মন্ত্রীসভার সাধারণ কার্যকালের মেয়াদ হল ৫ বছর। তবে বিধানসভার আস্থা হারালে মন্ত্রিসভা কে পদত্যাগ করতে হয়।

রাজ্য মন্ত্রীসভার আয়তন: মন্ত্রীসভার আয়তন সম্পর্কে সংবিধানে কোনাে নির্দেশ নেই। তবে সম্প্রতি সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত ভেঙ্কটচেলাইয়া কমিশনের সুপারিশমতাে কোনাে রাজ্যে মন্ত্রীসভার সদস্য সংখ্যা বিধানসভার মােট সদস্যের শতকরা ১৫ জনের বেশি হবে না।

রাজ্য মন্ত্রীসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি

ভারতীয় সংবিধানে লিপিবদ্ধ আইন অনুযায়ী মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুসারে রাজ্যপালের নামে শাসনকার্য পরিচালিত হয়। রাজ্য প্রশাসন পরিচালনায় রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগের ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা হল রাজ্যের প্রকৃত শাসনক্ষমতার অধিকারী। নিম্নে রাজ্য মন্ত্রীপরিষদ বা মন্ত্রীসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি আলােচনা করা হল—

(১) নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ: মন্ত্রীসভা রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা সংক্রান্ত মূল নীতিগুলি নির্ধারণ করে। এই নির্ধারিত নীতিগুলিকে বাস্তবে কার্যকর করার জন্য মন্ত্রীসভা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে। নির্ধারিত নীতির ভিত্তিতে সরকারি বিভাগগুলি পরিচালিত হয়। বস্তুত এক্ষেত্রে মন্ত্রীসভা সামগ্রিকভাবে শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে।

(২) আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা: রাজ্য মন্ত্রীসভা আইন প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেকটি আইনের খসড়া বা বিল মন্ত্রীসভার নির্দেশে রচিত হয়। বিধানসভায় বিভিন্ন পর্যায়ে তর্ক বিতর্ক প্রভৃতির মধ্য দিয়ে যে-কোনাে বিল রাজ্যপালের স্বাক্ষরের মাধ্যমে আইনে পরিণত হয়। রাজ্য আইনসভায় প্রতি বছর যেসকল বিল আইনে পরিণত হয়, তার বেশিরভাগই হল সরকারি বিল, যা মন্ত্রীরাই উত্থাপন করে থাকেন। সরকারি বিল সাধারণত প্রত্যাখ্যাত হয় না, কারণ সরকারি বিল প্রত্যাখ্যাত হলে সমগ্র মন্ত্রিসভা কে পদত্যাগ করতে হয়। অনেক সময় কাজের বাড়তি বােঝা হ্রাসের জন্য এবং সময়ের অপচয় বন্ধ করতে আইনসভা মন্ত্রীসভাকে আইন প্রণয়নের দায়িত্ব দিতে পারে, যাকে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন (delegated legislation) বলা হয়।

(৩) রাজ্য সরকারের আয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ: রাজ্য মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সরকারের কর বা ট্যাক্স নির্ধারণ করা, আয়ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা, বাজেট প্রস্তুত করা এবং আর্থিক বছরের শুরুতে অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে তা বিধানসভায় পেশ করা। এ ছাড়া রাজ্যের কর-কাঠামাে এবং ব্যয় বরাদ্দ স্থির করা প্রভৃতি বিষয়ে অর্থদপ্তর নীতি নির্ধারণ করে থাকে। মন্ত্রীসভার দ্বারাই রাজ্যের আয় ব্যয় নিয়ন্ত্রিত হয় বলেই বর্তমানে রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সচল রাখা সম্ভব হয়েছে।

(৪) অর্ডিন্যান্স জারি: রাজ্য আইনসভার অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন সময়ে রাজ্যপাল জরুরি প্রয়ােজনে মন্ত্রী পরিষদের পরামর্শক্রমে অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স জারি করতে পারেন। তবে এ ধরনের অর্ডিন্যান্সকে রাজ্য আইনসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার ৬ সপ্তাহের মধ্যে অনুমােদিত হতে হয় রাজ্য আইনসভার দ্বারা, নচেৎ তা বাতিল হয়ে যায়।

(৫) বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপন: রাজ্য মন্ত্রী পরিষদ বা মন্ত্রীসভার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়সাধন করা। বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে কোনাে বিরােধ উপস্থিত হলে বা কাজে অসংগতি দেখা দিলে মন্ত্রীসভা সেই অসংগতি দূরীভূত করতে সচেষ্ট হয়।

(৬) সরকারি কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ: মন্ত্রীসভার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সরকারি কর্মচারীদের অভাব-অভিযােগের নিরসন করা, কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং পরিচালনা করা। মন্ত্রীসভা বিভিন্ন দপ্তরের পদস্থ কর্মচারীদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে তাদের বদলির ব্যবস্থা করা, কাজকর্মের গতির বৃদ্ধি ঘটানাে প্রভৃতির জন্য প্রয়ােজনীয় নীতি নির্দেশিকা জারি করে।

(৭) আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়সাধন: রাজ্য মন্ত্রীসভার আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়সাধনের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে মন্ত্রীসভা শাসন বিষয়ক নীতি ও পরিকল্পনা রচনা করে, অন্যদিকে মন্ত্রীসভার মাধ্যমে আইনসভা প্রশাসনিক যাবতীয় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত হয়।

(৮) পরিকল্পনাকে বাস্তবে কার্যকর করা: গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের নানারূপ দাবিকে বাস্তবে কার্যকর করার জন্য পরিকল্পনার রূপরেখা রচনা করা হয়েছে। এই পরিকল্পনাকে বাস্তবে কার্যকর করার জন্য মন্ত্রীপরিষদ বা মন্ত্রীসভার প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়।

মূল্যায়ন: বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংসদীয় কার্যপ্রণালী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলির পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যের মন্ত্রীসভাও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। ভারতে দেখা যায় যে, রাজ্য মন্ত্রীসভার ক্ষমতা প্রাথমিকভাবে ক্যাবিনেট ভােগ করে আর চূড়ান্তভাবে মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে। তা ছাড়া রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার প্রয়ােগের ফলে মন্ত্রীসভার প্রাধান্য হ্রাস ঘটাতে পারে, পদমর্যাদা ক্ষুন্ন হতে পারে। পাশাপাশি এ কথা যথাযথভাবে বলা যায় যে, যেহেতু মন্ত্রীসভার পিছনে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকে তাই মন্ত্রীসভার পরামর্শকে রাজ্যপাল সবসময় উপেক্ষা করতে পারেন না। এখানেই রাজ্য মন্ত্রীসভার গুরুত্ব। কারণ রাজ্যপাল হলেন মনােনীত শাসক আর মুখ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রীসভা হল জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দ্বারা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসক।