ভূমিকা: বিধানসভার কার্যতালিকায় কোনাে বিষয় অন্তর্ভুক্ত না থাকলে সাধারণত সে বিষয়ে সভায় আলােচনার কোনাে সুযােগ পাওয়া যায় না। ব্যতিক্রম হিসেবে মুলতুবি প্রস্তাবের কথা বলা হয়। মুলতুবি প্রস্তাব প্রসঙ্গে বিধানসভার কার্যবিধির (Rules of Procedure and Conduct of Business in the West Bengal Legislative Assembly) নবম অধ্যায় (Chapter IX) ৫৯ নং থেকে ৬৫ নং ধারায় নিয়মাবলির মধ্যে আলােচনা আছে।

মুলতুবি প্রস্তাবের সংজ্ঞা: বিধানসভার অধিবেশন চলাকালীন এমন কোনাে পরিস্থিতি বা বিষয়ের সৃষ্টি হতে পারে, যা অতিমাত্রায় জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃতির হয়ে থাকে। বিষয়টি এমনই জরুরি ও সুনির্দিষ্ট প্রকৃতির যে উপেক্ষা করলে দেশ ও দেশবাসীর স্বার্থ ও নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। এইরকম ক্ষেত্রে মুলতুবি প্রস্তাবের মাধ্যমে বিষয়টি বিধানসভার আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বিষয়টির প্রয়ােজনীয়তা এতটাই যে বিলম্ব করা উচিত হবে না। এই কারণেই মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপনের দিনেই আলােচনা করতে হয়। দিনের অধিবেশন আরম্ভ হওয়ার আগেই মুলতুবি প্রস্তাবের নােটিশ জারি করতে হয়। বিধানসভার নির্দিষ্ট আলােচ্যসূচি মুলতুবি রেখে এই প্রস্তাবের আলােচনার ব্যবস্থা করা হয়। তাই এই প্রস্তাব মুলতুবি প্রস্তাব নামে পরিচিত।

মুলতুবি প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্য: মুলতুবি প্রস্তাবের তিনটি বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয় হল- (a) প্রস্তাবটি সুনির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত, (b) বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি প্রকৃতির এবং (c) জনস্বার্থের দিক থেকে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য অধ্যক্ষের অনুমতি অপরিহার্য। অধ্যক্ষ অনুমতি দিলে বিষয়টি নিয়ে বিধানসভায় আলােচনা করা যায়। সাধারণত সরকারবিরােধী সদস্যদের পক্ষ থেকেই মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়।

মূলত মুলতুবি প্রস্তাব হল বিরােধীদের হাতের সরকার বা বিরােধীদের একটি হাতিয়ার। সভার বিরােধী পক্ষ এই হাতিয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি ব্যর্থতা, নিষ্ক্রিয়তা ও প্রশাসনিক ত্রুটি বিচ্যুতির প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও সমালােচনা করে। বিধানসভায় মুলতুবি প্রস্তাব পাস হয়ে গেলে তা সরকারের নীতির বিরুদ্ধে তীব্র বিরােধিতা হিসেবে বিবেচিত হয়।

মুলতুবি প্রস্তাবের পদ্ধতি: কেবলমাত্র অধ্যক্ষের অনুমতিক্রমে মুলতুবি প্রস্তাব আনা যায়। দিনের আলােচনার বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য সমগ্র বিধানসভার অনুমােদন আবশ্যক। বিধানসভার কর্মসূচি মুলতুবির উদ্দেশ্যে কোনাে বিধায়ক অনুমতির জন্য আবেদন করতে পারেন। নির্দিষ্ট জনস্বার্থ বিষয়ক জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলােচনার সুযােগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সেই দিনের কার্যসূচি মুলতুবি রাখার জন্য আবেদনসূচক নােটিশ দিতে হয়। বিধানসভার সচিবের কাছে এই নােটিশ করতে হয় এবং তা করতে হয় সেই দিনের অধিবেশন শুরু হওয়ার অন্তত এক ঘন্টা আগে। এই নােটিশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবের একটি কপি এবং প্রস্তাবিত আলােচ্য বিষয়টির উপর একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি থাকা দরকার। নােটিশটি যদি এক ঘন্টা আগে না হয়ে এক ঘণ্টা পরে গৃহীত হয়, তা হলে ধরে নেওয়া হবে যে, নােটিশটি বিধানসভায় পরের দিনের অধিবেশনের জন্য গৃহীত হয়েছে। যাইহােক মুলতুবি প্রস্তাবের নােটিশটির ব্যাপারে অধ্যক্ষ অনুমতি দিয়েছেন কি না, বিধানসভার সচিব তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সদস্যদেরকে জানিয়ে দেন।

মুলতুবি প্রস্তাবের শর্তাবলির উত্তর: মুলতুবি প্রস্তাব পেশ করার অধিকার কতকগুলি শর্তপূরণ সাপেক্ষ। এই শর্তগুলি উল্লেখ করা আবশ্যক। এগুলি হল一

  • এক দিনের অধিবেশনে একাধিক মুলতুবি প্রস্তাব পেশ করা যাবে না।
  • এরকম একটি প্রস্তাব একাধিক বিষয়কে আলােচনার জন্য অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
  • সম্প্রতি সংঘটিত সুনির্দিষ্ট একটি ব্যাপার বা বিষয়ের মধ্যেই প্রস্তাবটি সীমাবদ্ধ থাকবে।
  • বিশেষাধিকার সম্পর্কিত কোনাে প্রশ্ন প্রস্তাবের মধ্যে থাকবে না।
  • চলতি অধিবেশনেই আলােচিত হয়েছে এমন কোনাে বিষয়ের পুনরায় আলােচনার উদ্যোগ এই প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত হবে না।
  • বিচার বিবেচনার জন্য আগেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে এমন কোনাে বিষয়কে এই প্রস্তাবের বিষয় করা চলবে না।
  • আদালত বা ট্রাইবিউনালে বিচারাধীন কোনাে বিষয়কে এই প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
  • সংবিধান বা বিধানসভার কার্যবিধি অনুযায়ী যে বিষয় সচিবের কাছে পৃথক লিখিত নােটিশের মাধ্যমে প্রস্তাব কে উত্থাপন করতে হয়, তা এই প্রস্তাবের মাধ্যমে উত্থাপন করা যাবে না।
  • রাজ্য সরকারের সঙ্গে সম্পর্করহিত কোনাে বিষয় মুলতুবি প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত হবে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, দেশের রাজনীতিক অবস্থা, রেল দুর্ঘটনা, কারখানা লকআউট, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি প্রভৃতি সাধারণ বিষয়ে মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন করা যায় না।

দৃষ্টি-আকর্ষণ প্রস্তাবের সংজ্ঞা : সংসদীয় কার্যপদ্ধতির ইতিহাসে ভারতের অন্যতম মৌলিক অবদান হল ‘দৃষ্টি আকর্ষণীয় প্রস্তাব। এই পদ্ধতি ভারত অন্য কোনাে দেশ থেকে গ্রহণ করেনি, নিজ অভিজ্ঞতায় সৃষ্টি করেছে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের আগে এই বিজ্ঞপ্তি জারির কোনাে ব্যবস্থা কোথাও উল্লেখ ছিল না। ওই বছর থেকে ভারতীয় পার্লামেন্টে এইরূপ বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার ব্যবস্থা প্রথম চালু হয়।

পরবর্তী সময়ে রাজ্য বিধানমণ্ডলীও পার্লামেন্টের পথ অনুসরণ করতে শুরু করে। এরূপ একটি অভিনব বিষয়কে সংসদীয় নিয়মাবলিতে স্থান দেওয়ার কারণ হল ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভা বা রাজ্য আইনসভায় যেসব মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়, সেগুলি কার্যত সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবের প্রকৃতিবিশিষ্ট হওয়ায় এই ধরনের প্রস্তাব উত্থাপন ও গ্রহণ কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। অথচ এমন কিছু জরুরি ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থমূলক বিষয় থাকে, সেগুলি সম্পর্কে অতি সত্বর সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা একান্ত প্রয়ােজন। যে পদ্ধতির মাধ্যমে তা করা যায়, তাকে দৃষ্টি আকর্ষণ বিজ্ঞপ্তি বলা হয়। দৃষ্টি-আকর্ষণ প্রস্তাব বিরােধী ও সরকার উভয় পক্ষের কাছে একটি অত্যন্ত কার্যকরী পদ্ধতি বলে বিবেচিত হয়।

দৃষ্টি-আকর্ষণ প্রস্তাবের শর্তসমূহ : দৃষ্টি আকর্ষণ প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়ে কয়েকটি নিয়ম বা শর্ত রয়েছে। যেমন一

  • প্রস্তাবটিকে জনস্বার্থজড়িত এবং জরুরি বিষয় হতে হবে।
  • প্রস্তাবটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মন্ত্রীকে দেওয়া হবে কি না, প্রস্তাব নিয়ে কোনােরকম আলােচনা হবে কি না সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা স্পিকার বা অধ্যক্ষের হাতে রয়েছে।
  • দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব সংক্রান্ত নােটিশ লিখিতভাবে সভার সচিবের কাছে জমা দিতে হবে।
  • একই দিনে একাধিক নােটিশ জমা পড়লে স্পিকার বা অধ্যক্ষ তার মধ্য থেকে যেটি খুব জরুরি সেটির অনুমােদন দিতে পারেন।
  • দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাব যে দপ্তরের মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য উত্থাপন করা হয়, স্পিকার সেই মন্ত্রীকে উত্তর দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে থাকেন। তবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী প্রস্তাব উত্থাপনের দিন বা অন্য যে-কোনাে দিন এই উত্তর দিতে পারেন।

দৃষ্টি-আকর্ষণী প্রস্তাবের বিষয়বস্তু: দৃষ্টি-আকর্ষণী বিজ্ঞপ্তির অন্তর্ভুক্ত যেসব বিষয়ের উপর মন্ত্রীদের বিবৃতি দিতে হয় সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য কিছু বিষয় হল ভারতের যে-কোনাে প্রান্তে বিশৃঙ্খলা, সীমান্ত নিয়ে সমস্যা, রেলওয়ে দুর্ঘটনা, সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত সংস্থার কাজকর্ম বন্ধ করে দেওয়া, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বা আধিকারিকদের কাজকর্ম প্রসঙ্গে আদালতের বিরূপ মন্তব্য, বিমানবন্দর, রেলওয়ে ও অন্যান্য সরকারি সেবামূলক ক্ষেত্রে ধর্মঘট, ভয়ংকর খাদ্য সমস্যা, ভয়াবহ খরা ও বন্যার মতাে প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতি।

দৃষ্টি-আকর্ষণ প্রস্তাবের গুরুত্ব: এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পার্লামেন্ট বা রাজ্য বিধানমণ্ডলীর যে-কোনাে কক্ষ জরুরি বিষয়সমূহে কেবল সরকারের বিবৃতিই দাবি করে না, এরসঙ্গে সে ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী, কী কী প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা ইতিমধ্যে গৃহীত হয়েছে, ভবিষ্যতের জন্য সরকার কোন কোন্ পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভেবেছে। প্রভৃতি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কক্ষের সদস্যদের অবহিত করতে হয়। বিরােধী পক্ষের সদস্যরা দিনের প্রথম ভাগে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা, নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে যে অভিযােগ তােলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীগণ তার জবাব দিয়ে এইসব অভিযােগের ভিত্তিহীন প্রমাণের জন্য তৎপর হন।

তবে বলা যায় যে, সরকারের বিরুদ্ধে অপদার্থতা ও দায়িত্বহীনতার অভিযোগ এনে বিরােধী দলগুলি জনমতকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে দৃষ্টি-আকর্ষণ বিজ্ঞপ্তি কিছুটা হলেও প্রয়ােগ করতে সক্ষম হয়।