আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রত্যেক দেশের বিচার বিভাগের ভূমিকাই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সংবিধানের ব্যাখ্যা কর্তা ও রক্ষাকর্তারূপে পরিচিত বিচার বিভাগ নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। কিন্তু কখনাে-কখনাে গণতন্ত্রের সার্থক রূপায়ণ ঘটাতে এবং নাগরিকদের বিভিন্নভাবে বনার শিকার হতে দেখে বিচার বিভাগ তার নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের উর্ধ্বে উঠে জনস্বার্থের কথা মাথায় রেখে, বিচারব্যবস্থার সক্রিয় ভূমিকা পালনে অগ্রসর হয়। বিচার বিভাগের সক্রিয়তা বলতে বােঝায়, বিচার বিভাগ তার স্বাভাবিক এন্টিয়ার অতিক্রম করে যদি ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং জনস্বার্থে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে সক্রিয়তা দেখায় তখন তাকে বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তা (Judicial Activism) বলে। এই ব্যাপারে বিচারপতি পি বি সাওয়ন্ত বিচার বিভাগীয় সক্রিয়তার ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে, “Judicial activism may be defined as the action of the Judiciary which tends to increase on legislative and executive fields.” Judges not only direct the executive, they also try to monitor action and counter inaction”.
[1] কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দান : আবহমানকাল ধরে আইন ও শাসন বিভাগের এক্তিয়ারে যে-সমস্ত বিষয় বিবেচিত হয়, সাম্প্রতিক বিচার বিভাগ সেই সমস্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে এবং কর্তৃত্ব কায়েম করছে। এই প্রবণতা বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তার পরিচায়ক। অনেকক্ষেত্রেই বিচার বিভাগ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছে। যেমন— ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় সরকার ও হরিয়ানা সরকারকে বেগার শ্রমিকদের মুক্তিদান ও পুনর্বাসন বিষয়ে, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে শ্রমিকদের একটি বিশেষক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরিদানের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশদান, ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে বিচারপতি লাহােটি ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় আস্থাভােট সংক্রান্ত বিষয়ে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তার অনন্য নজির হিসেবে বিবেচিত হয়।
[2] সংবিধানের মৌলিক কাঠামাে রক্ষায় বিচার বিভাগের ঐতিহাসিক রায় : সংবিধান অনুসারে বিচার বিভাগ হল নাগরিক মৌলিক অধিকারের রক্ষাকর্তা। আইন বিভাগ এবং শাসন বিভাগ কর্তৃক নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হতে হয়। এই কারণেই ভারতে মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য সুপ্রিমকোর্ট গঠন করা হয়েছে। এই সুপ্রিম কোর্ট জটিলতা দূর করার জন্য ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তার উল্লেখযােগ্য উদাহরণ স্থাপন করেছে। যেমন—১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে গােলকনাথ মামলা সুপ্রিম কোর্ট ঘােষণা করে পার্লামেন্ট নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংকুচিত করতে পারে না। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে কেশবানন্দ ভারতী মামলা সুপ্রিম কোর্টের ঘোষণা করে পার্লামেন্ট সংবিধানের মৌলিক কাঠামােকে পরিবর্তন করতে পারে না। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের মিনার্ভা মিলস মামলা সুপ্রিম কোর্ট ৪২ তম সংবিধান-সংশােধনী আইনের সিদ্ধান্তকে বাতিল করতে পারে।
[3] জনকল্যাণমূলক নির্দেশ : জনসাধারণের কল্যাণ ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট অনেক ক্ষেত্রেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। মানুষের দুঃখ কষ্ট নিবারণের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ বা অধস্তন আদালতে বহু ও বিভিন্ন নির্দেশ প্রদান করে। এ ছাড়া বিচার বিভাগ জনস্বার্থ রক্ষার্থে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বঞ্নাবােধ প্রতিরােধ করার জন্য একাধিক মামলায় যুগান্তকারী রায় প্রদান করে থাকে। যেমন ওড়িশার কালাহান্ডি অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ মােকাবিলায় রাজ্য সরকারের ভূমিকা তদন্ত করে দেখার জন্য সুপ্রিম কোর্ট ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দ জানুয়ারি মাসে সংশ্লিষ্ট জেলা জজ কে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেয়। এ ছাড়া ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে সরকারি কর্মচারীদের ধর্মঘটকে বেআইনি ঘােষণা করে ওই বছর ১৪ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়দান করে জানায় যে, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিকেলের সরকারি কলেজে ভরতির সময় মােটা অঙ্কের ক্যাপিটেশন ফি নেওয়া যাবে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চড়া হারে ফি বসিয়ে মুনাফা করা যাবে না।
[4] সামাজিক কল্যাণমূলক নির্দেশ : সামাজিক কল্যাণ ও সামাজিক সংস্কারসাধনের স্বার্থেও বিচার বিভাগ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তা ছাড়া বিচার বিভাগ জনস্বার্থ রক্ষায় তার ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনস্বার্থ সুরক্ষিত রেখে জনসমর্থন লাভ করেছে, এইরকম উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও কম নয়। যেমন— ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিমকোর্ট শাহাবানু মামলায় নারীর মর্যাদা ও অধিকারের পক্ষে রায় দান করে। অনাথ ও দাবিহীন শিশুদের বেচাকেনার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করার পক্ষে রায়দান, বেগার প্রথা বিলােপ, বেগার শ্রমিকদের যুক্তি ও পুনর্বাসন বিষয়ে রায় প্রদান প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।
[5] পার্লামেন্ট ত্রিশঙ্কু হলে বা দুর্বল হলে : নির্বাচনে কোনাে দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হলে অথবা দুর্বল প্রকৃতির সরকাররূপে পরিচিত হলে জনস্বার্থ রক্ষায় সরকার ব্যর্থ হয়। ফলে বিচার বিভাগের সক্রিয় উদ্যোগ জরুরি হয়ে পড়ে।
বিচারবিভাগীয় সক্রিয়তার সমালােচনা
[1] অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ: অনেকে বিচার বিভাগের সক্রিয়তাকে অবাঞ্ছিত বলে অভিহিত করেন। বিচার বিভাগের সক্রিয়তা সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক বলে মনে করা হয়।
[2] সাংবিধানিক ভারসাম্য লঙ্ঘন: সংবিধান-প্রণেতারা গণপরিষদে ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ (Principles of checks and balance) বজায় রাখার জন্য সংবিধান রচনা করেছিলেন, তার ফলে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের উপর বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা লঙ্ঘিত হয়েছে।
[3] স্বৈরাচারিতার পক্ষপাতিত্ব: বিচার বিভাগীয় সক্রিয়তা হল একধরনের অনাচার বা এক দুঃসাহসিক কর্মপ্রচেষ্টা যা দেশকে পরিণামে বিচারবিভাগীয় স্বৈরাচারিতার দিকে ঠেলে দেয়। এই প্রসঙ্গে বিচারপতি ননী পালকিওয়ালার মতে, বিচারালয়ের সক্রিয়তার আর-একটি নাম হল বিচারালয়ের রোমাঞ্চকর কার্যাবলি অথবা অতিরিক্ত বিচারালয়ের অনুপ্রবেশ যা আসলে দেশের বিচারালয়ের অবক্ষয় (“Judicial activism becomes another name for Judicial adventurism or Judicial excessivism that ultimately lead to Judicial despotism in the Country.”)।
[4] অতিসক্রিয়তা দোষে দুষ্ট: অনেকে উপহাস করে বলেছিলেন যে, বিচার বিভাগ সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন ও প্রচারের লােভে সক্রিয় ভূমিকা থেকে অতিসক্রিয় ভূমিকা পালনের পথে অগ্রসর হচ্ছে। বিচার বিভাগ অতিসক্রিয় ভূমিকা দেখাতে গিয়ে নিজেই নিজের প্রতিপক্ষ হয়ে সমালােচিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দিল্লির দায়রা বিচারকের মন্তব্য হল, পার্লামেন্ট নাকি মাছের বাজার এবং সংসদে দায়িত্বহীন বিশৃঙ্খল জনতা। যদিও এই ব্যাপারে দিল্লি হাইকোর্ট এরূপ মন্তব্য বাতিল ঘােষণা করেছে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বিশ্বের সব দেশের মতাে ভারতের বিচারব্যবস্থায় গতি আনতে, এমনকি জনস্বার্থের মতাে স্পর্শকাতর বিষয়গুলির সপক্ষে রায় প্রদান করতে গিয়ে বিচার বিভাগের কিছু অংশের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
তবে এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো যদি দায়িত্বশীল হয়ে জনস্বার্থে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তাহলে বিচার বিভাগের সক্রিয় ভূমিকা পালনে কোনোরূপ অবকাশ ঘটত না। গণতন্ত্রের সার্থক রূপায়ণ তখনই সম্ভব যখন আইনসভা ও শাসন বিভাগ সার্থক ও যথার্থভাবে তাদের দক্ষতা পালনে সক্ষম হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে, যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলির ব্যক্তিস্বার্থে কিংবা দলীয় স্বার্থে কাজ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে ন্যায়বিচারের দীপ নিভে যেতে বসেছে। এরূপ অন্ধকারময় অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তির আলাে পাওয়ার আশায় মানুষ বিচার বিভাগের উপর আস্থাশীল হয়ে পড়েছে। সুতরাং শেষ বিচারের আশায় তথা জনস্বার্থ রক্ষা এবং প্রগতিশীল কাজকর্মে বিচার বিভাগের এই সক্রিয়তার যে বিশেষ প্রয়ােজন রয়েছে, এ কথা গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে সমর্থনযােগ্য বলে বিবেচিত হয়।
হাইকোর্টের গঠন ও কার্যাবলি ব্যাখ্যা করাে।
মৌলিক অধিকার রক্ষায় হাইকোর্টের ভূমিকা ব্যাখ্যা করাে।
Leave a comment