ভাষা সম্পর্কিত কমিশনের অভিমত
জাতীয় সংহতি বজায় রাখার জন্য একটি অতি প্রয়ােজনীয় অস্ত্র হল ভাষা। জাতীয় সংহতি বজায় রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিকতাবােধের বিকাশের জন্যও আধুনিক যুগে ভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতার পর দেশের উচ্চশিক্ষার সংস্কারের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন শিক্ষার মাধ্যম কোন্ ভাষায় হবে তা নিয়ে বিশেষ আলােকপাত করে। কারণ বহুভাষাভাষী মানুষের দেশ এই ভারতে ‘ভাষার বৈচিত্র্য’ সেই পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সেইসময় ভারতে প্রায় তিনশােরও বেশি ভাষা প্রচলিত ছিল। ওই ভাষাগুলির মধ্যে সাহিত্যসম্পদ সমৃদ্ধিযােগ্য ভাষার সংখ্যা ছিল প্রায় ১২টি। হিন্দি ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা, কিন্তু হিন্দিকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় মর্যাদা দিতে গেলে আরও বেশি সাহিত্যসমৃদ্ধ হতে হবে বলে শিক্ষাবিদরা মনে করেছিলেন।
অন্যদিকে, দেশের শিক্ষিত মানুষজনের কাছে ইংরেজি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা, কিন্তু ব্রিটিশ শাসনে ইংরেজি ছিল ভারতবাসীর চরম শত্রুর ভাষা। তাই শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজিকে প্রাধান্য না দিয়ে ভারতীয় কোনাে ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রতিই অধিকাংশের মনােভাব ছিল। আবার জাতীয়তাবাদের বিকাশে ইংরেজি ভাষাকে সরকারি কাজকর্ম, অফিস, আদালত এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র থেকে অপসারণ করা প্রায় অসম্ভব ছিল।
এমতাবস্থায়, ভাষা সম্পর্কে বিভিন্ন দিক পর্যালােচনা ও বিশ্লেষণের পরে জাতীয় সংহতি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ভাষা সম্বন্ধে কমিশন কিছু সুপারিশ করে। কমিশন যেসব গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নথিভুক্ত করে, সেগুলি হল—
(১) ত্রিভাষা নীতি: মাধ্যমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত কমিশন ত্রিভাষা নীতির সুপারিশ করেছিল। এই তিনটি ভাষা হল—
- মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা,
- রাষ্ট্রভাষা বা হিন্দি এবং
- ইংরেজি ভাষা।
(২) মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষার স্বীকৃতি : উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় বা আঞ্চলিক ভাষায় বিষয়বস্তু আলােচনা করা যেতে পারে, তার জন্য সরকারি স্বীকৃতি থাকবে।
(৩) ভারতীয় অন্য ভাষা : উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেই ইংরেজির পরিবর্তে সংস্কৃত বাদে অন্য একটি ভারতীয় ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
(৪) দেবনাগরী লিপি : রাষ্ট্রভাষা লেখার ক্ষেত্রে দেবনাগরী লিপি ব্যবহার করতে হবে।
(৫) পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন : আঞ্চলিক ভাষা এবং রাষ্ট্রভাষার উন্নতির ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভাষাতত্ত্ববিদ এবং বিজ্ঞানীদের নিয়ে বাের্ড গঠন করে বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
(৬) ইংরেজি ভাষার চর্চা : মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার্থীরা যাতে ইংরেজি ভাষার চর্চা করার সুযােগ পায়, সেই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(৭) শব্দভাণ্ডার উন্নয়ন : বিভিন্ন উৎস থেকে শব্দ সংগ্রহ করে যুক্তরাষ্ট্রীয় একটি ভাষার শব্দভাণ্ডারের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
(৮) ভারতীয় পরিভাষায় গ্রহণ : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে যেসব ভাষা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, সেগুলিকে ভারতীয় পরিভাষায় গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে।
Leave a comment