১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে ভারতবর্ষ একটি প্রজাতান্ত্রিক তথা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করে। দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে এই গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে প্রয়ােজন হয় প্রাথমিক শিক্ষার। অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তনের তাগিদে রাষ্ট্রনেতা তথা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ সমবেত হন। এর পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার মানােন্নয়ন ও প্রযুক্তি-কারিগরি শিক্ষার পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয় স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশন, যা ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন’ বা ‘রাধাকৃষ্মণ কমিশন’ নামে পরিচিত।

বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের বিচার্য বিষয় সমূহ

ভারত সরকারের নির্দেশে ১০ জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্মণের সভাপতিত্বে ভারতের উচ্চশিক্ষা বিষয়ক পরিকাঠামাের মানােন্নয়নের লক্ষ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অনুসন্ধান চালান। কমিশনের বিচার্য বিষয়রূপে যেগুলি নথিভুক্ত হয় তার মধ্যে অন্যতম ছিল—

  • উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ,
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামােগত উন্নয়ন ও পরিচালনা ব্যবস্থা,
  • পরীক্ষা ব্যবস্থা ও মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কারসাধন,
  • শিক্ষক-শিক্ষণের ব্যবস্থা,
  • পাঠক্রম ও শিক্ষার মাধ্যম নির্ধারণ,
  • ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রয়ােগ,
  • নারীশিক্ষার মানােন্নয়ন,
  • ছাত্রকল্যাণ,
  • ভারতীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ,
  • গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় গঠন ও তার প্রশাসন পরিচালনা,
  • অন্যান্য বিচার্য বিষয় প্রভৃতি।

(১) উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ : ভারতে উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কী হওয়া উচিত তা স্থির করা ছিল এই কমিশনের প্রধানতম লক্ষ্য।

(২) বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামােগত উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যবস্থা: বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক কাঠামাে কেমন হবে; প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজীয় স্তরে শিক্ষার কাঠামাে কেমন হবে; কত বছরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের গ্রহণ করতে হবে তা স্থির করা; বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের যােগ্যতা নির্ণয় এবং বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত প্রশাসনিক কার্যকলাপ কীভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করা ছিল কমিশনের অন্যতম বিচার্য বিষয়। এ ছাড়া পরীক্ষাগার, লাইব্রেরি প্রভৃতির সংস্কার সম্পর্কে আলােচনা, উচ্চতর স্তরে গবেষণার জন্য কীভাবে উচ্চমানের গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করা যায়, সে সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেছিল কমিশন।

(৩) পরীক্ষা ব্যবস্থা ও মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কারসাধন: প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত পরীক্ষা ব্যবস্থা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিকে নতুন করে গড়ে তােলার কথা চিন্তা করে কমিশন। বছরে ক-টি পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে, নম্বর বিভাজন ও প্রশ্নকাঠামাে কেমন হলে তা শিক্ষার্থীর যথাযথ মূল্যায়নে সমর্থ হবে— এইসব বিষয়গুলিও কমিশনের বিবেচ্য ছিল।

(৪) শিক্ষক-শিক্ষণের ব্যবস্থা: বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের শিক্ষাগত যােগ্যতা কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে বিবেচনা করতে হবে। এ ছাড়া তাদের বেতন, চাকুরির শর্ত, বয়সের ঊর্ধ্বসীমা, সুযােগসুবিধা, ছুটি, দায়িত্ব-কর্তব্য কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা দিতে বলা হয়েছিল। সর্বোপরি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অধ্যাপকদের বিশেষ শিক্ষাগ্রহণের জন্য অনুরােধ করার কথাও ভাবা হয়েছিল।

(৫) শিক্ষার পাঠক্রম ও শিক্ষার মাধ্যম: উচ্চশিক্ষাস্তরে পাঠক্রম কী হবে সে বিষয়ে ঠিক করতে হবে। বলা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষার প্রধান প্রধান শাখাগুলির মধ্যে সমতা রক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ মানবিক বিষয় (Humanities), বিজ্ঞান, প্রযুক্তিগত বিজ্ঞান ইত্যাদি প্রচলিত শাখাগুলির মধ্যে সমতা রক্ষা করে পাঠক্রম রচনা করতে হবে।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার মাধ্যম কী হওয়া উচিত তা নিয়ে আলােচনা করে কমিশন। মাতৃভাষা এবং ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদানের কথা বলা হয়।

(৬) ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা: কমিশন গঠনের সময় ভারতীয় সংবিধান কার্যকরী না হলেও ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সে বিষয়ে সকলের মনে বদ্ধমূল ধারণা ছিল। তাই ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সমন্বয়ী ধর্মীয় শিক্ষা প্রয়ােজন। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ধর্মীয় শিক্ষা সম্পর্কে কমিশনকে সুপারিশ করতে বলা হয়েছিল। ছাত্রদের কীভাবে আচরণভিত্তিক নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা যায়, সে ব্যাপারেও কমিশনের কিছু চিন্তাভাবনা ছিল।

(৭) নারীশিক্ষার মানােন্নয়ন: স্বাধীনােত্তর ভারতে নারীজাতিকে স্বাবলম্বী করে তােলার লক্ষ্যে কমিশন নারীশিক্ষার প্রতি বিশেষ গরত্ব আরােপ করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় যাতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও সমান সুযােগ পায়, সেদিকে কমিশনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল।

(৮) ছাত্রকল্যাণ: বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীর সার্বিক কল্যাণের জন্য কী ধরনের কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে, ছাত্রাবাসের সমস্যা, শিক্ষার্থী-শৃঙ্খলা, টিউটোরিয়াল ক্লাস প্রভৃতি সম্পর্কে কমিশনকে সুপারিশ করতে বলা হয়েছিল।

(৯) ভারতীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ: ভারতীয় সংস্কৃতি, সাহিত্য, ভাষা, দর্শন, চারুকলা ইত্যাদি বিষয়ে উন্নততর পঠনপাঠনের ব্যবস্থা কীরূপ হওয়া উচিত সে বিষয়ে কমিশনকে সুপারিশ করতে বলা হয়েছিল।

(১০) গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় গঠন ও পরিচালনা: স্বাধীনতা লাভের সময় ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল খুবই কম। বিশেষত গ্রামাঞলে বিদ্যালয়ের সংখ্যাও খুব অল্প ছিল। তাই রাধাকৃষ্মণ কমিশনের অন্যতম বিচার্য বিষয় হয়েছিল গ্রামীণ শিক্ষা এবং সেই সূত্রে গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় গঠন।

(১১) অন্যান্য বিচার্য বিষয়: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাসংক্রান্ত মূল ভাবনাগুলি ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমােদিত কলেজগুলির শিক্ষার মানােন্নয়ন কীভাবে করা যায়, উচ্চতর গবেষণার ক্ষেত্রে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য আর্থিক সংস্থান কীভাবে করা সম্ভব সুপারিশের অধিকার ছিল।

সর্বোপরি, প্রাক্-স্বাধীনতাকালে ভারতে যে দুটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ও আলিগড় ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল, স্বাধীনােত্তর ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে তাদের অবস্থান কী হবে তা ছিল কমিশনের অন্যতম বিচার্য বিষয়। তা ছাড়া দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্বভারতীয় রূপদানের মতাে বিশেষ সমস্যাগুলির সমাধান কীভাবে করা যাবে তা নিয়েও কমিশনের সুপারিশের প্রয়ােজন ছিল।

সবশেষে বলা যায়, কেন্দ্রীয় সরকার বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার অংশরূপে বিবেচনা করেনি। সরকারের কাছে এই শিক্ষা ছিল বিশেষধর্মী। তাই প্রতিটি বিষয়ে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আবশ্যিকতা ছিল এবং সংবিধান রচনার পূর্বে গঠিত এই শিক্ষা কমিশনের ভারতীয় সমাজের প্রতি দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি ও সুগভীর।