জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬ খ্রিঃ.) তৃতীয় অংশে ‘জাতীয় ব্যবস্থায় শিক্ষা’ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃতি কী হবে এবং শিক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণ করবে, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে।
ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যই হল জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। এই প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষানীতির (১৯৮৬ খ্রিঃ.) বক্তব্য গুলি হল—
(১) জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা: শিক্ষার একটি ন্যূনতম স্তর পর্যন্ত জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়াই হল জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মূল কাজ। এই উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় খরচ বহন করবে সরকার।
(২) সাধারণ শিক্ষা কাঠামো : জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় ১০+২+৩ কাঠামোর প্রচলিত হয়েছে, তা চালু রাখতে হবে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে কয়েকটি উপস্তরে ভাগ করার কথা বলা হয়েছে।
(৩) জাতীয় আবশ্যিক পাঠক্রম (National Core Curriculum) : জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি জাতীয় আবশ্যিক পাঠক্রম থাকবে। পাঠক্রমে এমন অভিজ্ঞতা অন্তর্ভুক্ত করা হবে যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে এবং আগামী দিনে তারা নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে সক্ষম হয়। যেমন— ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, সাংবিধানিক কর্তব্য, জাতীয় ভাবধারা বিকাশে সহায়ক বিভিন্ন বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত থাকবে। পাঠক্রমের মধ্যে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্য, মূল্যবােধ প্রভৃতি গুণাবলি বিকাশের উপযােগী বিষয়বস্তুঅন্তর্ভুক্ত থাকবে। এইভাবে শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে উঠবে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, বিশ্বমানবতাবােধ, আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি, সমঝােতাবােধ প্রভৃতি।
(৪) জীবনব্যাপী শিক্ষা : জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬ খ্রিঃ.) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জীবনব্যাপী শিক্ষা (Life-long Education)। আর একটি সার্থক হলে সর্বজনীন সাক্ষরতা সম্ভব হবে। তাই প্রথা বহির্ভূত ও পত্রযোগে শিক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে।
(৫) পারদর্শিতার মাপকাঠি : শিক্ষা প্রত্যেক স্তরে কমপক্ষে কতটুকু পারদর্শিতা অর্জন করলে তাকে শিক্ষিত বলে বিবেচনা করা হবে, তাও জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে।
(৬) জাতীয় সংস্থার ওপর গুরুত্ব আরোপ : জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬ খ্রিঃ.)-কে কার্যকর রূপ দেওয়ার জন্য কতগুলো জাতীয় সংস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হবে। যেমন— জাতীয় শিক্ষাগত গবেষণা ও প্রশিক্ষণ সংস্থা (National Council of Educational Research and Training- NCERT), জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনা ও প্রশাসনিক সংস্থা (NIEPA), জাতীয় শিক্ষক-শিক্ষণ সংস্থা (National Council of Teacher Education- NCTE), ACT, IMC প্রভৃতি।
(৭) গবেষণা ও বিকাশ : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উচ্চতর গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। গবেষণার ক্ষেত্রে এমন পরিবেশ রচনা করতে হবে যাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে যােগাযােগ রক্ষিত হয় এবং নিজেদের মধ্যে তথ্য ও সম্পদ আদানপ্রদানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের ধারা বজায় থাকে।
(৮) উচ্চশিক্ষা ও টেকনিক্যাল শিক্ষা : উচ্চশিক্ষা ও টেকনিক্যাল শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি যাতে তাদের সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
(৯) মুক্ত শিক্ষা ও দূরাগত শিক্ষার বিকাশ : প্রগতির ধারায় সমৃদ্ধশালী করতে মুক্ত শিক্ষা ও দূরাগত শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার প্রসার ঘটবে শ্রমিক, কৃষক, গৃহবধূ, যুবসম্প্রদায় প্রভৃতি সকলের মধ্যে।
(১০) শিক্ষাকে যুগ্ম তালিকায় অবস্থান : জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর করার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার একত্রে দায়িত্বগ্রহণ করবে।
১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের সংবিধান সংশোধনে শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার মূলত শিক্ষার সর্বভারতীয় মান, জাতীয় সংহতি, উন্নত গবেষণার ক্ষেত্র, জাতীয় চাহিদা অনুযায়ী মানবসম্পদের বিকাশ ইত্যাদি প্রসঙ্গে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা বজায় রেখে কাজ করবেন। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের উপর খবরদারি করবে না। জাতীয় স্বার্থে সংবিধানে যে যৌথ দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে, তা উভয়েই (কেন্দ্র ও রাজ্য) পালন করবে।
উপরোক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় শিক্ষানীতিতে জাতীয় ব্যবস্থায় শিক্ষা সম্পর্কে যে আলোচনা হয়েছে তা বাস্তবসম্মত ও যুগোপযোগী, তবে বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে শিক্ষা ব্যবস্থায় আরও আধুনিকীকরণের প্রয়োজন।
Leave a comment