কোঠারি কমিশন শিক্ষাক্ষেত্রে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দশ বছরের সাধারণ শিক্ষার কথা উল্লেখ করেছে। সাধারণ শিক্ষা শিক্ষার্থীর ভিত্তিস্বরূপ। এই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের উদারমনস্ক করে, সমাজে সকলের সমান অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে, জাতি ধর্ম বর্ণ, নির্বিশেষে সকল মানুষ এক এই ধারণা দেয়। ওই দশ বছরের সাধারণ শিক্ষা গ্রহণের ফলে শিক্ষার্থী জীবনের মূল্যবোধ সংক্রান্ত ধারণা গ্রহণে সক্ষম হবে। এর পরবর্তীকালে বিশেষীকরণ বা অন্যান্য প্রকার শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।
(১) সর্বজনীন শিক্ষা : এই প্রকার শিক্ষা সমাজের সকল স্তরের মানুষদের জন্য উন্মুক্ত। যে-কোনাে মেধার শিশুই এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। নিজস্ব চাহিদা, সামর্থ্য, প্রবণতা অনুযায়ী শিশুরা এই শিক্ষার স্তরগুলি অতিক্রম করে।
(২) প্রথাগত শিক্ষার অংশ: সাধারণ শিক্ষা হল প্রথাগত শিক্ষার অংশবিশেষ। সাধারণ শিক্ষা, প্রথাগত শিক্ষার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং এই শিক্ষাগ্রহণের দ্বারা শিক্ষার্থীর বিভিন্ন দিকের বিকাশ ঘটে।
(৩) আন্তঃক্রিয়া মূলক প্রক্রিয়া: সাধারণ শিক্ষার একটি আন্তঃক্রিয়া মূলক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা পারস্পরিক ক্রিয়ার মাধ্যমে একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
(৪) ব্যক্তিত্বের বিকাশে সহায়ক শিক্ষা: সাধারণ শিক্ষা শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের বিকাশে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
কোঠারি কমিশন শিক্ষার উন্নতিকল্পে স্কুল জোট বা বিদ্যালয় গুচ্ছ গড়ে তােলার সুপারিশ করে। স্কুল জোট গড়ে উঠবে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় কে কেন্দ্র করে তার পার্শ্বস্ত প্রাথমিক, বুনিয়াদি ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলো নিয়ে। মাধ্যমিক স্কুল জোট সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের সংখ্যা হবে ১০ থেকে ২০টি। প্রতিবেশী বিদ্যালয়ের ধারণা থেকেই বিদ্যালয় গুচ্ছ গড়ে তােলার ভাবনা গড়ে উঠেছে। বিদ্যালয় গুচ্ছ গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য দুটি—
- বিভিন্ন ধরনের স্কুলগুলির মধ্যে যি বিচ্ছিন্নতা আছে, তা দূর করা।
- শিক্ষণবিভাগের হাতে যে ক্ষমতা আছে, তার কিছুটা বিকেন্দ্রীকরণ করা।
বিদ্যালয় গুচ্ছ তৈরি হলে বিদ্যালয় গুলোর মধ্যে যে বিচ্ছিন্ন ভাব রয়েছে, তা দূরীভূত হবে। শিক্ষার বিভিন্ন ধারার মধ্যে যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে, তার নিরসন হবে। জেলা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয় গুচ্ছ এর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে। স্কুলগুলো কাজের সমন্বয়ের ফলে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা আরও গতিশীল ও সজীব হয়ে উঠবে। তবে অন্যান্য বেশ কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে স্কুলজোট গঠনের কথা ঘোষণা করে কমিশন। সেগুলি হল—
(১) সহযোগিতার মনোভাব গঠনে: বিদ্যালয় গুলির মধ্যে বিচ্ছিন্ন মনোভাব দূর করে পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলা।
(২) শিক্ষামানের উন্নতি করা: বিদ্যালয়গুলোর উদ্দেশ্য হবে একযোগে পরস্পরের মধ্যে সম্পদের আদান প্রদান করে শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটানো।
(৩) শিক্ষকের মান: অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের উপযুক্ত যোগ্যতা অর্জনে সহায়তা করে।
(৪) পাঠ্যপুস্তকের মূল্যায়ন: জোটের অন্তর্গত বিদ্যালয় গুলো পাঠ্যপুস্তকের মূল্যায়ন করবে এবং বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ বিদ্যালয় গুলোর মধ্যে আদান প্রদান করবে।
(৫) সম্পদের ব্যবহার: স্কুল জোটের অন্তর্ভুক্ত প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকগণ একই সঙ্গে স্কুলের ল্যাবরেটরি পরিদর্শন ও ব্যবহার, লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করার সুযোগ ও বাৎসরিক খেলাধুলাতে যোগদানের সুযোগ পাবেন।
(৬) বিদ্যালয় পরিদর্শন: উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকগণ নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করলেন। তেমনি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রতি মাসে একবার নিকটবর্তী বিদ্যালয় গুলি পরিদর্শন করবেন।
(৭) বিদ্যালয় উন্নতিসাধন: স্কুল জোটের অন্তর্গত প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকগণ তাদের বার্ষিক শিক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করবেন। একই সঙ্গে প্রশ্নপত্র তৈরি করা, তার মূল্যায়ন করা ইত্যাদি বিষয়ে লক্ষ্য রাখবেন।
(৮) ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার: বিদ্যালয় প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকাদের জন্য ভ্রাম্যমান পাঠাগারের ব্যবস্থা থাকবে। মাঝে মাঝে আলোচনা সভা বসবে যাতে শিক্ষাকালীন শিক্ষার সাহায্যে শিক্ষার মানের উন্নতি করা যায়।
(৯) শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব পূরণ: বিদ্যালয়গুলিতে কয়েকজন অতিরিক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার ব্যবস্থা রাখতে হবে যার ফলে প্রয়োজনীয় শিক্ষক বা শিক্ষিকার জোগান দেওয়া যাবে স্কুলগুলিতে যেখানে পর্যাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব ঘটবে।
এইসকল উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কোঠারি কমিশন বিদ্যালয় গুচ্ছ গঠনের উপর জোর দেয়। সাধারণ শিক্ষার কাঠামোভুক্ত এই শিক্ষা ব্যবস্থার কার্যকারিতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে কমিশন মনে করেছিল।
Leave a comment