ভারতের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও, সবক্ষেত্রে এই শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য এখনও বাস্তবায়িত করা যায়নি। এগুলি বেশিরভাগই গুণগত দিক থেকে অত্যন্ত নিম্নমানের। তাই এই শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সকল সমস্যা গুলো দেখা যায়, সেগুলি হল—
(১) আর্থিক সমস্যা : এই শিক্ষাস্তরের উন্নতি ঘটাতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, শিক্ষা ক্ষেত্রে তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সরকারিভাবে যেসকল প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে উঠেছে, সেগুলোর বেশিরভাগই সাধারণের ক্ষমতার বাইরে। আর যেসকল সরকারি বিদ্যালয় রয়েছে, অর্থের অভাবে সেগুলির বেহাল অবস্থা হয়ে পড়ছে।
(২) উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব : প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য যে ধরনের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত উপযুক্ত শিক্ষকের প্রয়োজন পড়ে, তার অভাব যথেষ্ট। এই স্তরের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ধরনের বেতন দেওয়া হয়, সেই বেতনে উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
(৩) শিক্ষা উপকরণের অভাব : এই ধরনের বিদ্যালয়গুলিতে যে ধরনের শিক্ষা উপকরণের প্রয়োজন হয়, তার যথেষ্ট অভাব লক্ষ করা যায়, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলিতে—যা এই শিক্ষার সমস্যা গুলোর মধ্যে অন্যতম।
(৪) পদ্ধতিগত ত্রূটি : যেহেতু এই ধরনের বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক দ্বারা পড়ানো হয় না যেহেতু শিক্ষক-শিক্ষিকারা মনোবিজ্ঞান সম্মত শিক্ষা দান করতে পারে না।
(৫) শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত বৈষম্য : প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে গ্রামাঞ্চলে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ঠিক নেই। একজন শিক্ষক হয়তো ৬০-৭০ জন ছাত্র ছাত্রী পড়াচ্ছেন, ফলে শিক্ষার মান ঠিক থাকে না।
(৬) অভিভাবকদের উদাসীনতা : এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশের বেশিরভাগ অভিভাবকরাই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে সেভাবে সচেতন নন, তাই এই শিক্ষার অগ্রগতি এখনও ব্যাহত।
(৭) পাঠক্রমিক সমস্যা : বেশিরভাগ প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে খেলাধুলা ও সক্রিয়তা ভিত্তিক কার্যাবলী বদলে তাত্ত্বিক শিক্ষার উপর প্রাধান্য বেশি দেওয়া হয়; যার ফলে পাঠক্রমটি শিক্ষার্থীর কাছে বৈচিত্র্যহীন ও অনাকর্ষণীয় হয়ে পড়ে।
(৮) সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির অভাব : এই বিদ্যালয়গুলিতে সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ বিদ্যালয়ে সেরকম পরিকাঠামোর নেই বলে এই ব্যবস্থাও করা যায় না। তাই এটি একটি বড় সমস্যা।
(৯) অবৈজ্ঞানিক শিক্ষাদান পদ্ধতি : অধিকাংশ বিদ্যালয়গুলিতে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করা হয়, যার ফলে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা অনেক শিক্ষার্থীদের নিকট বোঝা হয়ে উঠেছে।
(১০) নিয়ন্ত্রণের সমস্যা : প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বেশিরভাগ ব্যক্তিগত ও সরকারি উভয় মালিকানায় থাকার কোনো নিয়ন্ত্রণের বিশেষ আইন এখনও পর্যন্ত চালু করা সম্ভব হয়নি, যার ফলে প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালকগণ নিজেদের মতো করে বিদ্যালয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
উপরোক্ত প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা গুলো সমাধান করতে হলে সরকারকে যেমন উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি যেসকল বেসরকারি ক্ষেত্রগুলি রয়েছে, সেগুলো এবং সর্বোপরি অভিভাবকদেরও এই ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে।
উপরোক্ত সমস্যাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে সমাধানের নিম্নলিখিত উপায়গুলি আলোচনা করা হল—
(১) প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ : প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং অভিভাবক সকলের পৃথক পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এই প্রশিক্ষণের জন্য রাজ্য ও জেলা স্তরে শিক্ষার বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করা দরকার।
(২) শিক্ষক নিয়োগ : প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষকের তুলনায় বেশি সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ প্রয়োজন।
(৩) সরকারি ও বেসরকারি অনুদান : প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি অনুদানের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং বেসরকারি সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে।
(৪) উপযোগী পরিবেশ : শিশুদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেমন—স্বাস্থ্যকর পরিবেশ প্রদান, শিক্ষা উপকরণের ব্যবহার, খেলাধুলার ব্যবস্থা ইত্যাদি।
(৫) খেলাভিত্তিক শিক্ষা : খেলাভিত্তিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের ফলে শিশুর মনকে আকৃষ্ট করে ও উৎসাহ সৃষ্টি হয়। তাই বিভিন্ন খেলার মাধ্যমে পড়াশোনা আয়ত্ত করার কৌশল প্রয়োগ করতে হবে।
(৬) গ্রামাঞ্চলে বিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি : গ্রামাঞ্চলে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র প্রায় নেই। তাই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে বেশি পরিমাণে।
(৭) পরিদর্শন : মাঝে মাঝে পরিদর্শন এর ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের কী ধরণের সুবিধা অসুবিধা হচ্ছে তা জানা যায়।
(৮) শিক্ষা উপকরণ : শিক্ষা উপকরণের যথেষ্ট পরিমাণ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে তাত্ত্বিক শিক্ষার একঘেয়েমি দূর হয়।
(৯) শিক্ষার্থী ও শিক্ষক শিক্ষিকার অনুপাত : শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার অনুপাত এমন হবে যাতে পড়াশোনা করতে কোন অসুবিধা না হয়। প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীর উপর শিক্ষক-শিক্ষিকা নজর দিতে পারে।
Leave a comment