কোঠারি কমিশন শিক্ষাক্ষেত্রে চারটি স্তর প্রবর্তনের কথা বলেছিল। সেগুলি হল— প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষার স্তর।
জন্মের পর থেকে শিশু পরিবারের মধ্যে প্রথম শিক্ষা পেলেও বর্তমান সমাজ পরিস্থিতি অনুযায়ী শিশুকে বিদ্যালয় নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার মাধ্যমে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাকে বলা হয় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা অর্থাৎ ২-৫/৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু যে শিক্ষা লাভ করে তাকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা বলে।
ড. ডি এস কোঠারী সভাপতিত্বে ১৯৬৪-৬৬ খ্রিস্টাব্দের যে কোঠারি কমিশনটি গঠিত হয়, তা আধুনিক যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করতে সুপারিশ করে। শৈশবে শিশুদের নির্দিষ্ট কতকগুলি উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। নিম্নে এই শিক্ষার উদ্দেশ্য, কাঠামো এবং পাঠক্রম সম্পর্কে আলােচনা করা হল —
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য
(১) সু-অভ্যাস গঠন : প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সাহায্যে শৈশবকাল থেকেই শিশুর মধ্যে কতকগুলি সু-অভ্যাস গঠন করা যায়, তবেই পরবর্তীকালে তার চরিত্র গঠনে সহায়ক হবে।
(২) দৈহিক বিকাশে : প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে অঙ্গ সঞ্চালনমূলক কাজের মাধ্যমে শিশুর দৈহিক বিকাশ ঘটানো।
(৩) সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা : এই শিক্ষাই শিশুর মধ্যে সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি প্রভৃতি গুণগুলোর বিকাশ ঘটিয়ে, শিশুর মধ্যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটানো।
(৪) সৌন্দর্য বোধের বিকাশ : প্রকৃতির রূপ, রস উপলব্ধির মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে সৌন্দর্য বোধের বিকাশ ঘটে এই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
(৫) শৃঙ্খলাবোধের বিকাশ : শৈশবে শিশুর অসংযত ও বিশৃঙ্খল আচরণে সংযত ও সুশৃঙ্খল করে গড়ে তোলা এই শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্দেশ্য।
(৬) আত্মপ্রত্যয় বা আত্মবিশ্বাস গঠন : এই শিক্ষার অপর গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হল শিশুর আত্মসক্রিয়তা ও আত্মপ্রচেষ্টার উপর গুরুত্ব দিয়ে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলা।
(৭) প্রাক্ষোভিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ : প্রাক্ষোভিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ দেওয়া এই স্তরের শিক্ষার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।
(৮) বাচনিক অভ্যাস গঠন : শিশুরা নিজস্ব চিন্তাধারা বা অনুভূতি যাতে যথাযথ প্রকাশ করতে পারে, তাই এই স্তরে নির্ভুলভাবে ভাষা প্রয়োগের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
(৯) মানসিক বিকাশ : এই বয়সের শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য নানা ধরনের ছবি আঁকা, গান, গল্প বলা, কবিতা বলা ইত্যাদি বিষয়ের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
(১০) কৌতুহলের বিকাশ : ছোট্ট শিশুরা সবকিছু জানতে চায়। তারা চারপাশের পরিবেশ, ঘটনা সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করে। তাদের মনে নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে অদম্য কৌতূহল। প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হল শিশুর মধ্যে নতুন নতুন আগ্রহ সৃষ্টি করা।
(১১) সৃজনশীলতার বিকাশ : কোঠারি কমিশন বলেছে, প্রত্যেক শিশু যাতে স্বাধীনভাবে তার ইচ্ছা ও আগ্রহ অনুযায়ী নিজের স্বত্তাকে বিকশিত করতে পারে তা দেখাই প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। সৃজনাত্মক কাজের মধ্যে ছবি আঁকা, আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটের কাজ, ছড়া গান, অঙ্গসজ্জা লোনের মাধ্যমে কবিতা বলা ইত্যাদি।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কাঠামো
ভারতীয় শিক্ষা কমিশন প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সর্বজনীন কাঠামো গড়ে তােলার প্রস্তাব করেনি। শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের পূর্বে এক থেকে তিন বছরের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে এই উদ্দেশ্যে কোন কোন শিক্ষালয় এক বছরের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা (Infant Class), আবার কোথাও দু-বছর বা তিন বছরের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেমন- নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন, মন্তেসরি বিদ্যালয়। ৩ বা ৪ বছর বয়সে পৌঁছালে এই স্তরের পাঠ গ্রহণের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে। এই পাঠ চলবে তাদের ৫ থেকে ৬ বছর পর্যন্ত। তবে তারা প্রাথমিক স্তরে ভর্তি হওয়ার উপযুক্ত হবে।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম
কোঠারি কমিশনে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পাঠক্রমের কথা বলা হয়নি। শুধুমাত্র কমিশনের সাধারণ নির্দেশনা অনুযায়ী সাত প্রকারের কার্যাবলী কথা বলা হয়েছে। সেগুলি হল—
(১) ক্রীড়া মূলক কার্যাবলী : শৈশবকাল থেকে শিশুর মধ্যে দৈহিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ সাধনের জন্য প্রাক্-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নানা ধরনের ক্রীড়া মূলক কার্যাবলীর প্রচলন করতে হবে।
(২) শারীরশিক্ষা : ২ থেকে ৫ বছরের শিশুর শারীরিক পুষ্টির পাশাপাশি শারীরিক গঠন ঠিক মতো হচ্ছে কি না সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। তাই প্রাক-প্রাথমিক স্তরে ছড়া গান ও নাচ, ব্রতচারী, যোগাসন ইত্যাদির প্রচলন করা প্রয়োজন।
(৩) কায়িক শ্রম : শিশুদের মধ্যে শ্রমের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য এবং তাদের পরিশ্রমী করার লক্ষ্যে কায়িক শ্রমের কমিশন পাঠক্রমের অন্যতম বিষয় রূপে সংযোজিত করেছে।
(৪) সংবেদনমূলক কার্যাবলী : কমিশন শিশুদের ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণ বা Sense training দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। অক্ষর চেনা, লিখতে শেখা, বলতে শেখা, যোগ-বিয়োগের ধারণা প্রদান, দূরত্ব ও সময় সম্পর্কে ধারণা প্রদান, নামতা বলে শেখানো ইত্যাদি সংবেদনপূর্ণ কাজ গুলো করার কথা বলা হয়েছে।
(৫) হস্তশিল্প ও সৃজনাত্মক কার্যাবলী : শিশুর প্রাক্ষোভিক চাহিদা ও সৌন্দর্য বোধের বিকাশ সাধনের জন্য নানা ধরনের হাতের কাজ, সেলাই, মাটির জিনিস বানানো ইত্যাদি প্রকল্প গ্রহণের কথা বলেছে কমিশন।
(৬) শিখন মূলক কার্যাবলী : প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ক্ষেত্রে শিশুদের নানা ধরনের আকৃতি চেনানোর, রং চেনানো, আঁকা শেখানো, কাগজ কেটে ছবি বানানো, পিচবোর্ডের জিনিস তৈরি ইত্যাদি শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়।
(৭) আত্মনির্ভরশীল কার্যাবলী : প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুরা যাতে তাদের নিজেদের কাজ নিজেরাই করে নিতে পারে, তার জন্য তাদেরকে স্বনির্ভর করে তোলার কথা বলে কমিশন। অর্থাৎ শিশুরা বাড়িতে ও বিদ্যালয়ে কীভাবে খাবে, কীভাবে শৌচাগার ব্যবহার করবে, কীভাবে মুখ-হাত-পা-ধুয়ে নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখবে ইত্যাদি কাজের শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়।
এ ছাড়া সৌন্দর্যবোধের বিকাশের জন্য বিদ্যালয় গৃহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, খেলার মাঠ, বিদ্যালয়ের চারপাশে ফুলের গাছ ইত্যাদি যেন রাখা হয়। যাতে চারপাশের পরিবেশ— সৌন্দর্য দেখে শিশুদের মনে সৌন্দর্য বোধের বিকাশ ঘটে।
মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য, সুবিধা ও অসুবিধাগুলি বিস্তারিত আলােচনা করাে।
Leave a comment