বাংলা রচনা : বাংলা কাব্যে রবীন্দ্রনাথ 

বাংলা কাব্যে রবীন্দ্রনাথ

[সংকেত: ভূমিকা, বাংলা কাব্যের ইতিহাস, আধুনিক বাংলা কাব্যে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব,  রবীন্দ্রনাথের কাব্যচর্চা, বাংলা কাব্য-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের সংযােজন, রবীন্দ্র কাব্যের বৈশিষ্ট্য, কাব্য সাধনা ও নোবেল পুরস্কার লাভ, রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কাব্যে প্রেমের স্বরূপ, ‘সােনার তরী’ কাব্যে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি ও মানবের প্রতি প্রেম, উপসংহার ।]

ভূমিকা : আবেগের সঙ্গে ছন্দের সংমিশ্রণেই কাব্যের উৎপত্তি। সুষম শব্দ বিন্যাস ও কল্পনামিশ্রিত ছন্দময় চিএাত্মক শিল্পকর্মকে। কবিতা বলে । বাংলা কাব্যের ঐতিহ্য হাজার বছরের । সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে অসংখ্য কবির হৃদয়ের বাণী বহন করে বাংলা কাব্য বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের অনুসারী হয়েই বাংলাদেশের কাব্য-সাহিত্য এ পযায়ে এসে। পৌছেছে। বাংলার কবি ও কাব্য সম্পর্কে কবি জসীমউদ্দীন বলেছেন—

কবি আর কাব্য
পাঠক আর সুধীবৃন্দ
করেছে শ্রাব্য
বিশাল জগৎ— কবি আর কাব্য
সুষমামণ্ডিত অন্বয় গড়েছে দিব্য। 

বাংলা কাব্যের ভুবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আবির্ভাব এক বিস্ময়কর ব্যাপার । বাংলা ভাষার পক্ষে, বাংলা সাহিত্যের পক্ষে, বাঙালি। জাতির পক্ষে, এমন গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় ঘটনা আর কখনাে ঘটেনি। শুধু বাংলা নয়, পৃথিবীতে ভাব, অনুভূতি ও রসসৃষ্টির ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথের দান এক অনুপম বৈশিষ্ট্য নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য-সৃষ্টি দেশ, কাল ও পাত্রের সংকীর্ণ গণ্ডি। অতিক্রম করে এক সর্বজনীন রূপ ধারণ করেছে ও বিশ্বসাহিত্য সভায় অপরূপ সৌন্দর্যে বিকশিত হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ কেবল। একজন শ্রেষ্ঠ কবিই নন, কিংবা তিনি শুধু ভাষা-সাধকই নন, তিনি একজন চিন্তাবিদ ও দার্শনিক হিসেবেও খ্যাত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন মনুষ্যত্বের সাধক।

বাংলা কাব্যের ইতিহাস : বাংলাদেশের কাব্য-সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের । হাজার বছরের এই ইতিহাস তিন ভাগে বিভক্ত।। যথা- প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক । প্রাচীনকালের কবিতার একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ’। এতে বৌদ্ধধর্মীয় সহজিয়াপন্থিদের জীবনদর্শন। বর্ণিত হয়েছে । মধ্যযুগের প্রারম্ভকালীন দেড়-দুশ বছর অর্থাৎ তেরাে ও চৌদ্ধ শতকে সামাজিক, রাজনীতিক বিপর্যয় ও অস্থিতিশীলতা এবং লেখ্য ভাষা হিসেবে বাংলা পুরােপুরি গড়ে না ওঠার কারণে বাঙালির কাব্যচর্চার ক্ষেত্রে বন্ধ্যা সময় অতিবাহিত হয়। চৌদ্দ শতকের শেষার্ধে অর্থাৎ ১৩৫০-এর পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের কাব্য-কথা রচিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য, মঙ্গলকাব্য, গাথাকাব্য, জীবনীকাব্য, রােমান্টিক কাব্য, রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গীতিকাব্য প্রভৃতি মধ্যযুগের অমূল্য অবদান । উনিশ শতকের প্রথম দিক থেকে আধুনিক কালের শুরু । আধুনিক যুগে রচিত কবিতাগুলাে পাশ্চাত্য সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আধুনিক বাংলা কাব্যসাহিত্য জীবনধর্মে উজ্জীবিত এবং এতে মানুষের সুখ-দুঃখ সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে ।

আধুনিক বাংলা কাব্যে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব : বাংলা কাব্য-সাহিত্যে বাঙালি মনীষার এক অভূতপূর্ব আশ্চর্য প্রকাশ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার বিচিত্র ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তুর গভীরতার জন্য তিনি যেমন অনবদ্য তেমনি সত্য, সুন্দর ও কল্যাণ এই ত্রয়ী বিশ্বজনীন বােধের ওপরেই তার সমগ্র সৃষ্টিকর্ম প্রতিষ্ঠিত। বস্তুত যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১১-১৮৫১) তার কবিতায় । মধ্যযুগীয় পয়ারমাত্রার মধ্যেই আধুনিকতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন । কিন্তু বাংলা কাব্য-সাহিত্যে আধুনিকতার ছােয়া লাগে মহাকবি। মাইকেল মধুসূদনের হাতে। তিনি মেঘনাদবধ কাব্যের মধ্য দিয়ে বাংলা কাব্যে পাশ্চাত্যের অনুকরণে মহাকাব্য রচনার ধারা প্রবর্তন। করেন। ভােরের পাখি বলে আখ্যায়িত বিহারীলাল চক্রবর্তী আধুনিক বাংলা কাব্যে ইউরােপীয় রােমান্টিক বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিহারীলাল চক্রবর্তী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। পরবর্তীকালে তারই হাতে বাংলা কবিতা পরম সার্থকতা লাভ করে ।। রবীন্দ্রনাথ তার রােমান্টিক বৈশিষ্ট্যের আলােকে স্বকীয় ভাবনাপ্রসূত দর্শনের সমন্বয়ে গভীর জীবনচেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রবীন্দ্র ভাবলােক, যা একাধারে ‘জীবনদেবতার’ দুয়ে রহস্যে আচ্ছন্ন, অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবন ও পারিপার্ষিক আবেগ-অনুভূতি। সমৃদ্ধ। এভাবে রবীন্দ্রনাথ বাংলা কাব্যে একটি স্বতন্ত্র ও সমৃদ্ধ সম্মােহনক্ষেত্র তৈরি করেন, ফলে তাঁর সমকালেই ববীড়ানসারী কবির। উদ্ভব ঘটে । তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমােহন বাগচী প্রমুখ ।

রবীন্দ্রনাথের কাব্যচর্চা : ঠাকুর পরিবারের সৃষ্টিশীল পরিমণ্ডলেই রবীন্দ্রনাথের কাব্যচর্চা শুরু । বডােদের কাচ নতন বউঠান কাদম্বরী দেবী তাকে দিতেন প্রেরণা। হিন্দুমেলা’, ‘বিদ্বজ্জন সভায় তিনি কবিতা পাঠ করেন । ১৩ বছর বয়সে তত্ত্ববােধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতা । এবার কবিপ্রাণে লাগে সৃষ্টির পুবালি হাওয়া কত ওঠে তাঁর মনের সাজি। তারপর তিনি লিখলেন বনফুল’। প্রকাশিত হলাে কবি-কাহিনী’ । ১৩ বছর থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত তার রচিত কবিতা সম্ভার নিয়ে বের হয় শৈশব সংগতি । এই ছিল রবীন্দ্রনাথের উত্তর কালের নেপথ্য প্রস্তুতি পর্ব ।

বাংলা কাব্য-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের সংযােজন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিভা বিচিত্র ও বহুমুখী হলেও তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি একজন কবি। তার কবি-কাহিনী’ (১৮৭৮), বনফুল’ (১৮৮০) ও ‘ভগ্নহৃদয়’ (১৮৮১) কাব্য তিনটিতে বিহারীলালের প্রভাব সুস্পষ্ট। সন্ধ্যাসংগীত’ (১৮৮২) কাব্যগ্রন্থ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে কবি রবীন্দ্রনাথের নিজের বাণী । এই পর্বের সন্ধ্যাসংগীত’, ‘প্রভাতসংগীত’ (১৮৮৩), ছবি ও গান’ (১৮৮৪) কাব্যগ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু ছিল মানবহৃদয়ের বিষন্নতা, আনন্দ, মর্ত্যপ্রীতি ও মানবপ্রেম। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত ‘মানসী’ এবং তার পর প্রকাশিত ‘সােনার তরী’ (১৮৯৪), “চিত্রা’ (১৮৯৬), চৈতালি’ (১৮৯৬), ‘কল্পনা’ (১৯০০) ও ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০) কাব্যগ্রন্থসমূহে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও সৌন্দর্য সম্পর্কিত রােমান্টিক ভাবনা। ১৯০১ সালে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। এই চিন্তাধারা পড়েছে। নৈবেদ্য’ (১৯০১), ‘খেয়া’ (১৯০৬), গীতাঞ্জলি’ (১৯১০), গীতামাল্য (১৯১৪) ও গীতালি (১৯১৪) কাব্যগ্রন্থে । ১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এ পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ অধ্যাত্মলােকের পরিবর্তে পুনরায় মর্ত্যলােকের দিকে ধাবিত হলেন । এই নবদৃষ্টির ফসল বলাকা’ (১৯১৬)। এরপর ‘পলাতকা (১৯১৮) কাব্যে গল্প কবিতার আকারে তিনি নারীজীবনের সামসময়িক সমস্যাগুলাে তুলে ধরেন। এরপর ‘পূরবী’ (১৯২৫) ও ‘মহুয়া’ (১৯২৯) কাব্যে কবি আবার ফিরে আসেন প্রেমের আশ্রয়ে। কবি জীবনের শেষ দশকে কবিতার আঙ্গিক ও বিষয়বস্তু নিয়ে কয়েকটি নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। প্রথমে প্রকাশিত হয় ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘শেষ। সপ্তক’ (১৯৩৫), পত্রপুট’ (১৯৩৬) ও শ্যামলী’ (১৯৩৬) নামে চারটি গদ্যকাব্য । এরপর জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে। ‘রােগশয্যা’ (১৯৪০), ‘আরােগ্য’ (১৯৪১), জন্মদিনে’ (১৯৪১) ও ‘শেষ লেখা’ (১৯৪১) (মৃত্যুর পরে প্রকাশিত) কাব্যে মৃত্যু ও মর্ত্যপ্রীতিকে তিনি একটি নতুন আঙ্গিকে পরিস্ফুট করেছিলেন। কবির শেষ কবিতা ‘তােমার সৃষ্টির পথ’ মৃত্যুর আট দিন আগে মৌখিকভাবে রচনা করেছিলেন।

রবীন্দ্র কাব্যের বৈশিষ্ট্য : রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা ভিন্ন শ্রেণির । বিশ্বমুখিতা ও সর্বজনীনতা তার প্রতিভার বৈশিষ্ট্য। দেশ, জাতি ও যুগের উর্ধ্বে যে সর্বজনীন ভাব, যে বিশ্বজনীন আদর্শ, যে চিরন্তন নীতি ও শাশ্বত সত্য, তারই ওপর রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিষ্ঠিত । দেশ-জাতি-কালের ঐতিহ্য ও সংস্কারকে তিনি ততখানি গ্রহণ করেছেন, যতটুকু তাঁর সর্বজনীন আদর্শ ও নীতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির সংকীর্ণ ধর্মসংস্কার, যুক্তিহীন সমাজব্যবস্থার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অন্ধভক্তি ছিল না। মনুষ্যত্বের সর্বজনীন মহান আদর্শ ও উচ্চ-নীতির কষ্টিপাথরে তিনি দেশ ও জাতির ভাবাদর্শ ও সংস্কার প্রথাকে বিচার করে গ্রহণ করেছেন। তিনি খণ্ডকে, বিচ্ছিন্নকে এড়িয়ে পরিপূর্ণতার দিকে, অখণ্ডের দিকে সর্বদা অগ্রসর হয়েছেন। কোনাে একটি বিশিষ্ট দেশ, জাতি ও সংস্কার-নিরপেক্ষ যে চিরন্তন সত্য ও আদর্শ, তাই তিনি অনুসরণ করেছেন তাঁর কাব্য-প্রচেষ্টায় । যুগ-প্রভাব তাঁর কবিচিত্তে আঘাত করে অনুভূতি ও আবেগে রূপান্তরিত হয়ে কোনাে কোনাে সময়ে অভিব্যক্ত হয়েছে বটে কিন্তু ওই যুগ সমস্যার মধ্যেই তাঁর কাব্যসৃষ্টি নিঃশেষ হয়ে যায়নি । যুগের মধ্য দিয়ে যুগাতীত অবস্থায় উন্নীত হয়েছে, যেখানে সর্বকালের সর্বমানবের সমস্যা রূপপরিগ্রহ করেছে।

কাব্য সাধনা ও নোবেল পুরস্কার লাভ : ১৮৮২ সালে কলকাতা ১০নং সদর স্ট্রিটে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ ‘নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতাটি রচনা করেন। এটি তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকর্মের ইঙ্গিতবাহী কবিতা। ১৮৮৩ সালের দিকে তিনি পিতার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ এবং পাবনার শাহাজাদপুরে জমিদারি দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। কলকাতার বাইরে পল্লিপ্রকৃতি ও তৃণমূল সংলগ্ন মানুষের মাঝে এসে তাঁর সৃষ্টিকর্ম নতুন সমৃদ্ধি লাভ করে। মানসী’, ‘সােনার তরী’, ‘চিত্রা’ প্রভৃতি বিখ্যাত কাব্য তিনি এ সময়েই রচনা করেন । তাঁর লেখা চলতে থাকে বিরামহীন । ১৯১১ সালের ৭ মে রবীন্দ্রনাথের বয়স ৫০ বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষ্যে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ কর্তৃক কবিকে দেশবাসীর পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। নিজের অনুবাদ করা এবং ইংরেজ কবি ডব্লিউ, বি, ইয়েটস-এর ভূমিকা লেখা ‘গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হলে ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নােবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯১৯ সালে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের কারণে তিনি ইংরেজদের দেওয়া নাইট’ (Knight) উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন।

রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’ কাব্যে প্রেমের স্বরূপ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় প্রতিটি কাব্যেই প্রেম বিষয়টি পরিলক্ষিত হয় । মানসী’ তাঁর। প্রথম সার্থক কাব্য সৃষ্টি। এ কারণে কাব্যটি উল্লেখযােগ্য। মানসী’ কাব্যে নর-নারীর প্রেমের স্বরূপ অভিব্যক্ত হয়েছে। যে প্রেম। বুভুক্ষিত দৃষ্টিতে দেহের চারপাশে ঘুরে মরে, ব্যক্তি মানুষের বাস্তব দেহ-মন যার ভিত্তি, সেই আবেগময়, আত্মহারা, সাধারণ মানুষের প্রেম রবীন্দ্রনাথের প্রেম নয়। মানসী’র ‘নিষ্ফল কামনা’ কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথের কল্পিত প্রেমের রূপটি সম্পূর্ণভাবে উদ্ঘাটিত হয়েছে। প্রেম অসীম, অনন্তের ধন, আত্মার সম্পদ, দেহের সীমায় তাকে ধরা যায় না। প্রেমপাত্রী নারীর নয়ন হতে ‘আত্মার’ রহস্যশিখা’র বিচ্ছুরণ দেখা যায় । সেই ‘অমৃত’, সেই ‘স্বর্গের অসীম রহস্য’ কে কবি দেহের মাঝে খুঁজে না পেয়ে অতৃপ্ত আকাক্ষার বেদনায় অস্থির হয়েছেন। সেই অসীম, অনির্বচনীয় প্রেম-ধনের অধিকারী যে নারী তাকে তাে দেহের মধ্যে পাওয়া যায় না। তাই কবি সমগ্র মানব’ কে পেতে চাওয়া দুঃসাহস বলে মনে করেছেন। কবি বলেছেন—

লও তার মধুর সৌরভ
দেখাে তার সৌন্দর্যবিকাশ
মধু তার করাে তুমি পান
ভালােবাসাে, প্রেমে হও বলী
চেয়াে না তাহারে
আকাক্ষার ধন হে আত্মা মানবের ।

প্রেম দেহসম্বন্ধ বিরহিত, অপার্থিব সৌন্দর্যের নিবিড় অনুভূতি, এক অনির্বচনীয় আনন্দরস। এই রসে সিঞ্চিত করে বিমুগ্ধ শিল্পীর মতাে তিনি প্রেমকে আস্বাদন করেছেন। কবির মানসী দেহসম্বন্ধের উগত এক চিরন্তন সৌন্দর্যময়ী নারী- যার আধষ্ঠান তাঁর চিত্তলােকে, যাকে তিনি মানবীর মধ্যে পাওয়ার জন্য বারবার আকাক্ষা করে ব্যর্থ ও হতাশ হয়েছেন। ‘মানসী’তে পূর্ণ যুবক কবির মধ্যে বাস্তব রূপ-রসের অতি প্রবল আকর্ষণ এবং বাস্তবাতীত সৌন্দর্যপ্রেমের জন্য তীব্র আকাঙক্ষা- এ দুয়ের দ্বন্দ্ব দেখা যায়। বাস্তব কামনা-বাসনার সংকীর্ণতা থেকে প্রেমকে মুক্ত করার জন্য এক বেদনাময় ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে ‘মানসী’ কাব্যে।

 ‘সােনার তরী’ কাব্যে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি ও মানবের প্রতি প্রেম : ‘সােনার তরী’র যুগে রবীন্দ্রনাথের কবিমানস এক বিশিষ্ট অবস্থায় উপনীত হয়েছে। এ সময়ে প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি কবির পূর্বের দৃষ্টিভঙ্গি পরিণত ও পরিবর্তিত হয়। এ কাব্যের অনেক। কবিতায় পদ্মাপাড়ের পলিপ্রকতির গভীর সংযােগ রয়েছে। সমগ্র গ্রন্থটি বাংলা কাব্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রােমান্টিক কাব্য সংকলন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আমার বুদ্ধি ও কল্পনা এবং ইচ্ছাকে উন্মুখ করে তুলেছিল এই সময়কার প্রবর্তনা, বিশ্বপ্রকৃতি এবং মানবলােকের মধ্যে নিত্য সচল অভিজ্ঞতার প্রবর্তনা । এই সময়কার কাব্যের ফসল ভরা হয়েছিল সােনার তরীতে। ‘সােনার তরী’ কাব্যের নাম। কবিতায় কবি জীবন ও তাঁর কীর্তির ক্ষণস্থায়ী অস্তিত্বের কথা বলেছেন। এই কবিতার শেষ পঙক্তি দুটি অবিস্মরণীয়—

শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি।
যাহা ছিল নিয়ে গেল সােনার তরী ॥ 

কবি ‘সােনার তরী’ কাব্যে প্রকৃতি ও মানুষের স্বকীয় স্পর্শে যেন নবীন রূপে সচকিত হয়ে উঠেছিলেন। কবি ‘মানসসুন্দরী’ কবিতায়। বলেছেন—

বিশ্বাস বিপুল
জাগে মনে-আছে এক মহা-উপকূল
এই সৌন্দর্যের তটে, বাসনার তীরে
মমাদের দোহার গৃহ ॥ 

উপসংহার : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় বাংলা কাব্য-সাহিত্য হয়েছে ব্যাপক সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারণশীল । বাংলা কাব্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার প্রয়াসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সফল হয়েছেন । রবীন্দ্রনাথকে কোনাে গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করা যায় না। তাঁর সাহিত্যজগৎ এতটাই সমৃদ্ধ যে, তাঁকে বাদ দিলে বাংলা সাহিত্য এক বিরাট অংশ থেকে বঞ্চিত হবে। কেননা বাংলা সাহিত্যের এমন কোনাে ক্ষেত্র নেই, যেখানে তিনি তাঁর পদচিহ্ন রাখেননি । তেমনি বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রেও রয়েছে তাঁর অসীম সৃষ্টি । তাঁর সৃষ্টির ঐশ্বর্যে পূর্ণ হয়ে আছে বাঙালির প্রাণ । তিনি তাঁর কবিতায় প্রকৃতি, প্রেম, আধ্যাত্মিক ভাবনা, মৃত্যুচেতনা, জীবন দেবতা, গতি ইত্যাদি বিষয় শিল্পিত মনের তুলিতে সুনিপুণ হস্তে অঙ্কন করেছেন। তাই বলা যায়, বাংলা-কাব্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান অপরিসীম ও অনস্বীকার্য ।