ধনের মানুষ অপেক্ষা মনের মানুষই বড়।
অথবা, বিত্ত হতে চিত্ত বড় ।
অথবা, ধনের মানুষ মানুষ নয়, মনের মানুষই মানুষ।

ভাব-সম্প্রসারণ : হৃদয়হীন ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তিরা মানুষের ওপর দৃশ্যত প্রভাব ফেললেও তারা মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিতে পারে না। অন্যদিকে, মানুষের প্রতি যাদের রয়েছে অসীম সহানুভূতি ও মমত্ব, যাদের হৃদয় সমুদ্রের মতাে বিশাল তারাই প্রকৃত মানুষ । অতএব, মানবজীবনে ধন-সম্পদের চেয়ে মনুষ্যত্বের মূল্যই অধিক। পার্থিব ধন ও মনের ধন— এই দুধরনের ধনে মানুষ ধনী হতে পারে । একদিকে ঐশ্বর্য আকাক্ষা, অন্যদিকে ত্যাগ-মহিমা; একদিকে আত্মসুখ, অন্যদিকে মানবকল্যাণ- মানবজীবনের এই দুই দিগন্ত । এক দিগন্ত তাকে ডাকে আত্ম-পরিধির মধ্যে, অন্য দিগন্ত ডাকে পরহিতে বিশ্ব পরিমণ্ডলে । মানুষকে এই দ্বৈত ডাক শুনে ধন ও মনের মধ্যে সুসংগতি স্থাপন করে নিতে হয় । বিত্ত যেন চিত্তহীন না হয় এবং চিত্ত যেন শুধু স্বপ্ন-বিলাসিতায় ডুবে না থাকে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। কেননা বিত্ত-বাসনা। ও চিত্ত-বিলাসের মধ্যে সুসংগতি স্থাপিত না হলে জীবনের সার্থকতা নেই। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে মনে হয়, যাদের প্রচুর টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত আছে তারাই বড়াে। বস্তুত তা নয়। পৃথিবীতে ধনের মানুষের চেয়ে মনের মানুষই বড়াে । মানবসমাজের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, অনেক মানুষ রয়েছে যারা অর্থ-সম্পদহীন, দরিদ্র । কিন্তু মানুষের কাছে তারা প্রচুর সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা পায়। এর কারণ তারা মনের দিক থেকে অনেক বড়াে। ক্ষুদ্র স্বার্থ বা নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকা তাদের স্বভাব নয়, বরঞ্চ তারা পরােপকারী এবং মানুষের বিপদের বন্ধু। তারা সমাজের ছায়া, জাতির আদর্শ। ফলে মানুষ তাদের ভুলে যায় না। পক্ষান্তরে, কিছু কিছু মানুষ রয়েছে যারা সবসময় নিজেদের স্বার্থ চিন্তায় মশগুল থাকে। ন্যায়অন্যায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে এসব মানুষ নানাভাবে অর্থ কামিয়ে সম্পদের পাহাড় বানায়। তারা সাময়িকভাবে সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং চাটুকারদের কাছ থেকে আন্তরিকতাহীন সম্মানও লাভ করে থাকে। অথচ সম্পদের দাপট ফুরালে তাদের আসল চরিত্র উন্মােচিত হয় এবং সমাজে অপাংক্তেয় বলে নিন্দিত হয়ে থাকে। এসব মনুষ্যত্বহীন লােক জীবিত অবস্থায় নগণ্য এবং মৃত্যর পর পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন তথা মানুষের মন থেকে চির-বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যায় । কিন্তু যারা হৃদয়বান, মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, জীবিত অবস্থায় তারা যেমন মানুষের ভালােবাসায় সিক্ত তেমনি মৃত্যুর পরেও মানুষ তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে । তাই তারা পৃথিবীতে মরেও অমর; সবার কাছে চিরদিন স্মরণীয় ও বরণীয় । অঢেল ধন-সম্পদ থাকা সত্ত্বেও যার মন ক্ষুদ্র, আত্মা দরিদ্র, মানুষ হয়েও সে পশুর চেয়ে অধম । প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য প্রয়ােজন মনের উদারতা এবং মনুষ্যত্ব অর্জন । অতএব, হৃদয়হীন ধনী ব্যক্তির সামাজিক প্রতিপত্তি থাকলেও মানবিক কোনাে শ্রদ্ধা তার প্রাপ্য নয়। তাই আমাদের বিত্তের চাইতে চিত্তের উৎকর্ষ অর্জনেই অধিক যত্নবান হতে হবে ।