বাংলা রচনা : কাজী নজরুল ইসলাম / আমার প্রিয় কবি


কাজী নজরুল ইসলাম / আমার প্রিয় কবি

[ সংকেত; ভমিকা; জন ও বাল্যকাল; সাহিত্যিক নজরুল বিদ্রোহী কবি নজরুল কাব্যে প্রেম ও সৌন্দর্য; নজরুল ইসলামের কবি প্রতিভা; সংগীত সাধক ফল; শেষ জীবন; উপসংহার। ]

ভূমিকা : বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত ও সমৃদ্ধ করে তােলার ক্ষেত্রে যেসব কবি-সাহিত্যিক বিশেষ অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম অন্যতম। কবিতাকে বাস্তব জীবনের সমস্যা ও লক্ষ্যের অনুগত করে সংগ্রামের হাতিয়াররূপে প্রয়ােগের গৌরব প্রথম নজরুলেরই । তিনি আমাদের জাতীয় কবি।

জন ও বাল্যকাল : বর্ধমান জেলার আসানসােল মহুকুমার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষার জনপ্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। আট বছর বয়সে কবি পিতৃহীন হন, সংসারে দেখা দেয় নিদারুণ দারিদ্র্য । আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য নজরুলের পাঠ্যজীবনে ব্যাঘাত ঘটে। গ্রামের মক্তব হতে তিনি নিম প্রাথমিক পরীক্ষা পাশ করেন। চৌদ্দ বছর বয়সে কবি রানীগঞ্জের শিয়ারশােল উচ্চ ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৭ সালে কবি যখন দশম শ্রেণির ছাত্র, তার বয়স তখন উনিশ বছর । তখন তিনি সৈনিক জীবন বরণ করেন এবং বাঙালি পল্টনে যােগ দিয়ে করাচি গমন করেন। এগারাে বছর বয়সেই নজরুলের কবি শক্তির স্ফুরণ ঘটে । যুদ্ধে যােগদান করলেও কাব্যচর্চায় তার বিরতি ছিল না। সে সময় ফারসি সাহিত্যের সাথে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত হন।

সাহিত্যিক নজরুল : গল্প রচনার মধ্য দিয়েই কবি নজরুলের লেখক জীবনের সূচনা। গল্প-উপন্যাস রচনা করলেও তিনি কবি। হিসেবেই বেশি পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় তিনি কবি। তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯১৮ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় নাম ‘মুক্তি’। ১৯১৯ সালে কবি করাচি হতে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে, বাঙালি পল্টন ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধফেরত নজরুল যে কবিতাটি রচনা করে অশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন তার নাম বিদ্রোহী’। কবিতাটি ১৯২০ সালে মােসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর হতে অজস্র রচনায় কবি বাঙালি পাঠককে একেবারে বিস্ময়াভিভূত করে রাখেন। দেশের তরুণ চিত্তে তিনি চিরকালের প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।

বিদ্রোহী কবি : নজরুলের বক্তব্যে ছিল দুস্থ, বঞ্চিত, বিক্ষুব্ধ, শােষিত মানুষের মুক্তির আশ্বাস । তার কণ্ঠে ছিল অন্যায়, অবিচার, জেল, জুলুম, নির্যাতন ও নিপীড়ন, অকল্যাণকর চিন্তা, অন্ধ কুসংস্কার ও অযৌক্তিক প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের সুর। নজরুল ছিলেন জীবনের, যৌবনের, প্রেমের ও সংগ্রামের কবি। তাঁর বিদ্রোহ, বিপ্লব ও জীবন সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল বিদেশি, বিজাতি, বিভাষী ব্রিটিশ শাসন-শােষণ থেকে স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জন । তাই তিনি ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন—

এদেশ ছাড়বি কি না বল
নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল ।


ব্রিটিশদের অধীনে থেকে তাদের বিরুদ্ধে এ কথা বলা যে কত বড়াে দুঃসাহসিক কাজ তা ভাবতেও অবাক লাগে । অন্য কোনাে কবির পক্ষে এত বড়াে কথা বলা সম্ভব হয়নি। আবার স্বদেশি মানুষকে শােষণমুক্ত করার জন্য সমাজকে ভেঙে কবি নতুন সমাজ গড়তে চেয়েছেন—

ধ্বংস দেখে ভয় কেন তাের?

প্রলয় নূতন সৃজন বেদন,

আসছে নবীন, জীবন হারা অসুন্দরে করতে ছেদন।

তাঁর কবিতায় স্বাধিকার আদায়ের কথা বলা হয়েছে বলে তিনি শুধু আমার নয় সকলের প্রিয় কবি ।

নজরুল কাব্যে প্রেম ও সৌন্দর্য : নজরুলের কাব্যের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হলাে প্রেম ও সৌন্দর্য চেতনা। ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবি ঘােষণা করেছিলেন— ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণ তুর্য।’ অনুপ্রাসের ধ্বনিমধুর এ ‘বাকা বাঁশের বাঁশরি’ ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন প্রেমিক কৃষ্ণের বাঁকা বাঁশির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। নজরুল একাধারে স্বাধীনতাকামী, শােষণমুক্ত সমাজ প্রত্যাশী, বজ্রকঠোর সংগ্রামী এবং প্রেম-স্নেহ-মমতা ভিখারি কুসুম-কোমল অন্তরের অভিমানী কবি। দোলনচাপা, ছায়ানট, সিন্ধুহিন্দোল, চক্রবাক, পূবের হাওয়া, নতুন চাঁদ প্রভৃতি কাব্যে নজরুলের প্রেমিকসত্তা মূর্ত হয়ে উঠেছে। বিগত শতাব্দীতে যারা হিন্দু-মুসলমানদের মৈত্রীর বাণী সার্থকভাবে প্রচার করেছেন তাঁদের মধ্যে নজরুল অন্যতম। তাঁর বিখ্যাত কোরাস ‘কান্ডারি হুশিয়ার’ এর শ্রেষ্ঠ প্রমাণ—

হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারি! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মাের মা’র! 

নজরুল ইসলামের কবি প্রতিভা : কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কবি। অসংখ্য কবিতা ও গান লিখে। তিনি আমাদের সাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। আধুনিক বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পর বিদ্রোহী কবি নজরুলের নামই বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তার অসাধারণ সৃজনী প্রতিভা সর্বজনস্বীকৃত। অভাবনীয় তারুণ্যের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেই তিনি সহসা একদিন আমাদের মাঝে এসে দাঁড়ালেন । নজরুলের প্রলয়ােল্লাস’ কবিতার তিনটি ছত্র এইরূপ :

‘তােরা সব জয়ধ্বনি কর, তােরা সব জয়ধ্বনি কর—
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল-বােশেখির ঝড়।’

এসব কথা কবির অতর্কিত আবির্ভাব সম্পর্কে সেদিনের বাঙালি কাব্য পাঠকের প্রাণের বাণী। সত্যই তিনি অদৃষ্টপূর্ব নতুনের জয়ধ্বজ ওড়ালেন। তার বিদ্রোহী’ কবিতাটির প্রকাশ বাংলা কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। একটি মাত্র কবিতা কবির খ্যাতি দেশময় পরিব্যাপ্ত করে দিল। 

রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’র যুগে ‘বিদ্রোহী’র কবি কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব । কবিগুরু যখন অমর যৌবনের জয়সংগীত উচ্চারণ করছিলেন, যখন তিনি চিরকালের সবুজকে অবুঝ ও আধমরাদের ঘা দিয়ে বাঁচাবার জন্য দেশের মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, তখনই নজরুল প্রতিভার উনেষ, । বিশ্বকবির চির সবুজদের গান এক প্রবল উন্মাদনা-উদ্দীপনায় বাংলার তরুণ প্রাণকে সঞ্জীবিত করে তুলেছিল । তার সে উদাত্ত সংগীত সেদিনের বাইশ বছরের তরুণ নজরুলের নবীন চিত্তকে উন্মাদ করে তুলেছিল বিদ্রোহীর ভূমিকায়। অবতীর্ণ হতে । তাঁর সেই দ্বিধাহীন দুর্দম, দুর্বার তারুণ্যের মধ্যে আমরা দেখলাম প্রতিভাদীপ্ত একজন সহজ কবিকে। কবির প্রথম যুগের কবিতায় ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল একটা প্রচণ্ড বিদ্রোহ ও সুতীব্র উন্মাদনার সুর । অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশী, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা, ফণিমনসা, সর্বহারা, সাম্যবাদী প্রভৃতি কাব্যে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার পীড়িত মানুষের পুঞ্জীভূত বেদনাকেই তিনি অগ্নিবীণাতে স্বতােৎসারিত ছন্দ-সুরে ধ্বনিত করেছিলেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা প্রকার অসাম্য-বৈষম্যের বিরূদ্ধে এমন প্রবল প্রতিবাদ সে যুগের অন্য কোনাে কবির রচনায় ধ্বনিত হয়ে ওঠেনি। ভাব, কল্পনা ও চিন্তার স্বকীয়তা, বাণী প্রকাশের বিস্ময়কর স্বতঃস্ফূর্ততা, অপার প্রাণশক্তির উচ্ছল উদ্দামতা, সংবেদনশীল হৃদয়ের উদ্বেল আবেগ-উচ্ছাস নজরুলের কাব্যকে একটা অসামান্য বিশিষ্টতা দান করেছে। 

সংগীত সাধক নজরুল : নজরুল প্রতিভার সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে সংগীত সৃষ্টিতে । প্রেমের গানে, ভক্তির গানে সত্যি তিনি। নিবিষ্টচিত্ত শিল্পী সাধক। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও অধিক। সংগীত রচনার ক্ষেত্রে কবির শিল্প সাধনা অনবদ্য হয়ে উঠেছে।

শেষ জীবন : ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে কবি মস্তিষ্কের পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে জীবন্ত অবস্থায় ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে দেশবাসী চাঁদা তুলে। তাকে চিকিৎসার জন্য বিলেতে পাঠিয়েছিলেন । কিন্তু ইউরােপের স্বনামধন্য মস্তিষ্ক চিকিৎসকেরা অভিমত প্রকাশ করেন যে, কবির। রােগ নিরাময়ের কোনাে সম্ভাবনা নেই । অতঃপর কবিকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়। তখন হতে ১৯৭২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কবি। কলকাতায় বাস করছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের মাসে কবিকে বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় সরকারের। অনুমতিক্রমে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। তখন হতে কবি ঢাকায় বাস করছিলেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সাহিত্যে । ডক্টরেট খেতাব দান করেন। ১৯৭৬ সালে কবিকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জাতীয়তা দান করেন এবং ঐ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে ২১ শে পদক প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট সকাল ১০টায় কবি ঢাকার পিজি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাধিস্থ করেন।

উপসংহার : নজরুলের সৃষ্টি অনেক । শুধু কাব্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটকই নয়; তিনি অসংখ্য সংগীতও রচনা করে গিয়েছেন । নজরুল নিজেও খুব ভালাে গাইতে পারতেন। তার বহু গান রেকর্ড হয়েছে। নজরুলের শ্যামাসঙ্গীত বিশেষ প্রসিদ্ধ। নজরুল ইসলাম। নিঃসন্দেহে বাংলা ও বাঙালির । তিনি শিশুদের জন্য যেমন লিখেছেন তেমনি বড়ােদের জন্য লিখেছেন । তিনি প্রচুর ইসলামি গান রচনা করেছেন। তিনি সাম্যের কথা বলেছেন, সবার মনের কথা বলছেন তাই তিনি আমার প্রিয় কবি।।