জনসংখ্যা ও জনশক্তি

[ সংকেত : ভূমিকা রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি; জনসংখ্যার আধিক্য; জনসংখ্যাধিক্যের ফলে সৃষ্ট সমস্যা; জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরের সুবিধা; জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার উপায়; দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ; উপসংহার । ]

ভূমিকা : বর্তমান বিশ্বে একটি বিরাট সমস্যা হলাে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তবে এ সমস্যা কেবল অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেই দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে এসব দেশ হিমশিম খাচ্ছে। একটি দেশের অপরিহার্য উপাদান হলাে সে দেশের জনসংখ্যা। জনসংখ্যাকে যদি দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা না যায় তখন সে জনসংখ্যা বােঝা হয়ে দাঁড়ায়। আর জনসংখ্যাকে যদি দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা যায় তাহলে সে দেশ উন্নতি লাভ করতে সক্ষম হয়। তাই একটি দেশের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে সে দেশের জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করা অত্যন্ত প্রয়ােজন। 

রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি : জনগণ রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি। রাষ্ট্রের মূল উপাদানও জনসংখ্যা। জনসংখ্যা ছাড়া রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে। জনহীন ভূখণ্ডকে রাষ্ট্র বলা যায় না। একটি রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভর করে তার জনগণের কর্মপ্রচেষ্টার ওপর। আমাদের এ সােনার বাংলায় একসময় ধন-সম্পদের প্রাচুর্য ছিল। গােলা ভরা ধান, গােয়াল ভরা গােরু আর পুকুর ভরা মাছ ছিল। এ উন্নয়নের মূল। শক্তি ছিল জনগণ। তারা কঠোর পরিশ্রম করে জমিতে ফসল ফলাত। তাদের জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছিল।

জনসংখ্যার আধিক্য: একটি দেশের মােট জনসংখ্যা যদি সে দেশের সম্পদের তুলনায় অধিক হয় তখন তাকে জনসংখ্যার আধিক্য বলে। আর সে দেশকে বলা হয় অধিক জনসংখ্যার দেশ। জনসংখ্যাধিক্য তখনই হয় যখন সম্পদ বণ্টন করে দেখা যায় যে, জনম শাখার সাহস পেয়েছে। সেইসাথে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে গেছে, দেশে বেকারত্ব বেড়ে গেছে। মানুষ দিন দিন দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করেছে। জনসংখ্যার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭.৫ কোটি। ২০১৭ সালে এসে তা দাড়িয়েছে প্রায় ১৭ কোটিতে। এদেশের জনসংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে অথচ দেশের। আয়তন কিন্তু বাড়েনি। তাছাড়া দেশে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে তাও প্রয়ােজনের তুলনায় অপ্রতুল। 

জনসংখ্যাধিক্যের ফলে সৃষ্ট সমস্যা: জনসংখ্যা রাষ্ট্রের মূল উপাদান তথা শক্তি হলেও অধিক জনসংখ্যা রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক। হুমকিস্বরূপ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে বাংলাদেশ নানা সমস্যায় জর্জরিত। কষিপ্রধান এদেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ করে জীবনধারণ করে। বছরের প্রায় ছয় মাসই আবার এদেশের কষকরা বেকার থাকে। দেশে যে কলকারখানা গড়ে উঠেছে তা প্রয়ােজনের তুলনায় নিতান্তই অল্প। ফলে দিনদিন খাদ্য সমস্যা, বেকার সমস্যা, বাসস্থান সমস্যা, শিক্ষার অভাব প্রভৃতি সমস্যা। অধিক জনসংখ্যার চাপে বেড়েই চলেছে। লােকজন কর্মসংস্থানের তেমন কোনাে সুযােগ পাচ্ছে না। 

জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরের সুবিধা : বর্তমান বিশ্বে জনসংখ্যাকে মানবসম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শিক্ষিত ও দক্ষ জনগােষ্ঠা একটি দেশের প্রাণশক্তি। একটি দেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারলে সেদেশের উন্নয়ন অবধারিত। কিন্তু সে জনসংখ্যা যদি অকেজো বা অকর্মণ্য থাকে তাহলে তা সেদেশ বা জাতির জন্য বােঝা হয়ে দাঁড়ায়। সুদক্ষ জনগােষ্ঠী গঠন ও দেশের অগ্রগতি সাধনে শিক্ষার ভূমিকা অনিবার্য। আমাদের দেশের জনসংখ্যা অধিক হলেও অধিকাংশ জনশক্তি অদক্ষ। অথচ একজন দক্ষ মানুষ একটি দেশের সম্পদ। আর অদক্ষ মানুষ বােঝা। অধিক জনসংখ্যার কারণে বাংলাদেশে নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে মানুষের মধ্যেও কেমন যেন অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ নানাভাবে খারাপ কাজে লিপ্ত হচ্ছে। এর মূল কারণ মানুষের কাজের অভাব। অন্যদিকে তারা দক্ষ জনশক্তি হিসেবেও গড়ে উঠতে পারছে না। এ জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারলে। দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসবে এবং মানুষের বেকারত্ব দূর হবে। ফলে সকলের জীবনে স্বস্তি আসবে। 

জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করার উপায় : আমাদের দেশের বিরাট জনগােষ্ঠীকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করা খুব কঠিন। কিছু নয়। এ বিশাল জনসাধারণকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হলে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়ােজন। অবশ্য এজন্য সরকারিবেসরকারি উভয় পর্যায়েই কাজ করা জরুরি। আমাদের দেশে যেহেতু সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হলে চাকরির সুযােগ পাওয়া কঠিন এ কারণে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষারও সুযােগ সৃষ্টি করতে হবে। কেননা কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে বিদেশে নানাভাবে কর্মসংস্থানের সুযােগ পাওয়া যাবে । শুধু তাই নয়, দেশের ভেতরেও অনেক ধরনের কাজের পথ সুগম হবে । তাছাড়া দেখা যায়, আমাদের দেশের বিপুল বেকার জনগােষ্ঠীর অধিকাংশই অশিক্ষিত। বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বের সাথে এদের কোনাে যােগাযােগ নেই। তাই এদের আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করাতে হবে এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। আবার প্রতিটি এলাকায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রসার ঘটালেও বেকার জনগােষ্ঠী দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হতে পারে। 

দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ : বাংলাদেশ সরকার দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তােলার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হলে প্রথমে যুবসমাজকে দক্ষ করতে হবে। এজন্য সরকার যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছে। দেশের প্রতিটি জেলাতেই এ অধিদপ্তরের শাখা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে । তাছাড়া কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেইসাথে এগুলাের আধুনিকায়নও করা হয়েছে। 

সরকার বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তােলাকেও স্বাগত জানিয়েছেন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে চালু করা হয়েছে। ভােকেশনাল কোর্স। সরকার সহজ শর্তে বিভিন্ন খাতে ঋণদানও নিশ্চিত করেছেন। তাছাড়া বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও আত্মকর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সহজ শর্তে বিভিন্ন খাতে ঋণদান করে যাচ্ছে। ফিশারিজ, ডেইরি, পােলট্রি ও খাদ্য। প্রক্রিয়াকরণ খাতে নেওয়া হয়েছে নব নব পদক্ষেপ। বিভিন্ন খাদ্য তৈরি, বুটিকস ইত্যাদি খাতেও নানা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।

উপসংহার : জনসংখ্যা ও জনশক্তি একটি দেশের মূলশক্তি। তবে তা যদি দেশের মােট ভূখণ্ড ও সম্পদের তুলনায় বেশি হয় তাহলে তা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। আমাদের দেশের অধিক জনসংখ্যা নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি করছে। ক্রমবর্ধমান এ জনসংখ্যাকে কাজে লাগানাের জন্য তথা দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার পথ সুগম করে তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই কেবল জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব হবে। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে নানা পদক্ষেপ নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সফলতার পরিচয় দিয়েছেন ।