একটি কষ্টকর স্মৃতি 

প্রথম বর্ষের সমাপনী পরীক্ষা শেষ করেছি মাত্র। শিবলু ভাইয়া বললেন, চল এবার আমার ওখানে মানে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার মুখ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা গল্প ইতােমধ্যেই আমাকে এতটা উদগ্রীব করেছে যে বলামাত্রই হ্যাঁ বলে দিলাম । অবশ্য এর আগেও অনেকবার যেতে চেয়েছি। কিন্তু ভাই সে সময় বলেছে ‘এখন তােকে নিয়ে যাওয়া যাবে না, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিক পরিস্থিতি ভালাে না। এবার যখন নিজেই বলল, তখন আব্বা-আম্মাও একবাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। সুতরাং আর কোনাে বাধাই থাকল না। রাত অনেক হয়েছে তবুও যেন ঘুম আসছে না। এটা একটা বদভ্যাস। কোনােখানে যেতে চাইলে সে রাতে আর সহজেই ঘুম আসে না। যাক সে কথা, পরের দিন সকালেই অটো-রিকশাযােগে সুন্দরগঞ্জ পৌছলাম। এরপর সােজা অনামিকা বাসে রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমরা দুপুরের পরপরই বিনােদপুরে পৌছলাম। এখান থেকে রিকশা করে শহিদ হাবিবুর রহমান হল। এই প্রথম আমার কোনাে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা। রিকশায় যেতেই ভাই মতিয়ার হল, শেরে-ই-বাংলা হল দেখাল। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ পার হয়ে সােজা উত্তর দিকে কিছুদূর গিয়ে দেখতে পেলাম ‘শহিদ হাবিবুর রহমান হল’ । বিশালাকৃতির ভবন। আমরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে একটু এগিয়ে ডানদিকেই ভাইয়ার ২২৪ নং কক্ষ। প্রবেশ করা মাত্রই ভাইয়ের বন্ধুরা আমাকে সাদরে গ্রহণ করল। ক্যান্টিন বয়কে অর্ডার দিয়ে এখানে দুপুরের সব খাবার ব্যবস্থা করল। আমরা হাত-মুখ ধুয়ে এসে খাবার সারলাম। খাবার পর বিশ্রাম; কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। প্রায় বিকেল ৪টায় ঘুম থেকে উঠলাম। তড়িঘড়ি করে বের হলাম- ভাইয়া ও তার বন্ধুরা একে একে বিজ্ঞানভবন, কলাভবন ও সামাজিক বিজ্ঞান ভবন দেখাল। এবার এলাম প্যারিস রােড; প্যারিস রােডের ডানপাশেই উপাচার্যের বিশাল বাসভবন; এরপর ডানদিকে সিনেট ভবন এবং আর একটু এগিয়ে প্রাশাসনিক ভবন। প্রাশাসনিক ভবনের সামনে শহিদ ড. শামসুজ্জোহার সমাধি। ১৯৬৯ সালে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী তাকে গুলি করে। মনটা একটু আহত হলাে; যাক ভাইয়া টুকিটাকির দিকে নিয়ে গেলেন; টুকিটাকি একটি চত্বরের নাম। এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। এগুলাে দেখে অভিভূত হয়ে গেলাম। শুনলাম আগামীকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে রাজশাহী অঞ্চলের উল্লেখযােগ্য লােকসংগীত গম্ভীরা অনুষ্ঠান রয়েছে। রাতে ফিরে হলে দেখলাম ডিশ এন্টিনায় নানা ধরনের ছবি । মনটা রােমাঞ্চিত হলাে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এত সুযােগ। পরের দিন সকাল দশটায় মিলনায়তনে প্রবেশ করতেই গুডুম করে একটি শব্দ- সবাই যেন হতচকিত; কিন্তু না শব্দ বেড়েই চলছে মিলনায়তন থেকে, রাস্তা থেকে সবাই দৌড় দিচ্ছে, যে যার নিরাপদ জায়গা মতাে। ভাইয়া শুধু বলল- গণ্ডগােল শুরু হয়েছে; জুতাে হাতে নে, দৌড়-দৌড়-দৌড়! রাস্তায় এসে দেখি ছাত্রদের ভিড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে আমরা একটা রিকশা নিয়ে মেহেরচণ্ডীতে চলে গেলাম। সেখান থেকেও যেন শুনতে পেলাম গুলির শব্দ। কী অদ্ভুত ব্যাপার। এত সুন্দর পরিবেশ অথচ এর মধ্যে এত গলদ। ভাই বলল ‘ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন রাজনীতিক দলে যুক্ত হয়ে একে অপরের সঙ্গে এ ধরনের রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়। আর এর চরম মূল্য দিতে হয় সকল ছাত্রছাত্রীকে। সারাদিন দুশ্চিন্তায় কাটল, বিকেলবেলা শুনতে পেলাম পুলিশ পরিবেশ শান্ত করেছে; সুতরাং আমরা ফিরে গেলাম। কিন্তু যা দেখলাম তা সত্যি আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিল। টুকিটাকির পাশে কৃষ্ণচূড়ার চমৎকার লাল ফুল আর মাটিতে লাল রক্ত; সন্ত্রাসী হােক, ছাত্র হােক আর অ-ছাত্র হােক- কোনাে মানুষ কি পারে অন্য মানুষের দেহ থেকে এভাবে রক্ত ঝরাতে? জানি এ প্রশ্নের সঠিক জবাব কেউ দিতে পারবে না। একটু পরেই শুনলাম বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসন বন্ধ ঘােষণা করেছে। ভাইয়া বলল- ‘হলে আর যাওয়া যাবে না, চল এভাবেই …। এক কষ্টকর স্মৃতি নিয়েই অগত্যা বাড়ি ফেরা।