বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা ও তার প্রতিকার
ভূমিকা : খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আশ্রয় মানুষের মৌলিক পাঁচটি চাহিদার মধ্যে খাদ্য হচ্ছে প্রধান। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে আবাদি জমির অনুপাতে জনসংখ্যা বেশি। প্রতিবছর জনসংখ্যার হার আরাে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবাদি জমি বাড়ছে না, বাড়ছে জনসংখ্যা। এ বাড়তি জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদাও ক্রমশ বাড়ছে। ফলে ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা মেটাতে সরকারকে প্রতিবছর হিমশিম খেতে হয়। জনসংখ্যার চাহিদার তুলনায় আমাদের দেশে খাদ্য উৎপাদন কম। এ ছাড়া প্রতিবছর বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রচুর পরিমাণে খাদ্যফসল নষ্ট হয়। ফলে খাদ্যঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে প্রতিবছর বিশ থেকে ত্রিশ লক্ষ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। তবুও দেশে খাদ্যাভাব পূরণ হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার চাপ। ফলে বাড়ছে দারিদ্র্য। ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার হচ্ছে বিশাল জনগােষ্ঠী।
বাংলাদেশে খাদ্য সমস্যার স্বরূপ : গােলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, কিংবদন্তির সােনার বাংলার সেই অবস্থা এখন আর নেই যদিও আজো এ দেশের মাঠে ফসল ফলে, নদীতে মাছ জন্মায়। কিন্তু মানুষের ঘরে সেই সমৃদ্ধি নেই, নেই সেই সচ্ছলতা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর কৃষিভূমি হ্রাসের ফলে উৎপাদিত খাদ্যশস্য মানুষের প্রয়ােজন মেটাতে পারছে না। ফলে এ দেশে খাদ্য সংকট বেড়েই চলেছে।
আবাদি জমির পরিমাণ দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের হানি প্রায় নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে। সার, কীটনাশক দিয়ে যতই উৎপাদন বাড়ানাে হােক না কেন সীমিত জমির উৎপাদন শক্তির তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। ফলে খাদ্য সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।
খাদ্য সমস্যার কারণ : আমাদের দেশে খাদ্য সমস্যার অন্যতম কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি। মানুষ বাড়ছে, কিন্তু জমি বাড়ছে না। ক্ষুদ্রায়তনের এই বাংলাদেশে আবাদি জমির পরিমাণ মাত্র শতকরা বিশভাগ, এটুকু জমির সবটাতে খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয় না। তা ছাড়া জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে বাসস্থান ও কলকারখানা নির্মাণের কাজে আবাদি জমি ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের জাতীয় আয়ের সিংহভাগই ব্যয় হচ্ছে খাদ্যশস্য আমদানি করতে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এভাবে অব্যাহত থাকলে, আগামীতে দেশের খাদ্যসংকট কী পরিমাণ হবে, তা কল্পনাও করা যায় না। সনাতন পদ্ধতির কৃষি উৎপাদন-ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের খাদ্যসংকটকে আরাে প্রকট করে তুলেছে। আমাদের দেশে সর্বত্র আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও কৃষিউৎপাদন ব্যবস্থা এখনাে রয়ে গেছে মান্ধাতার আমলে। সার এবং কীটনাশক ব্যবহার বৃদ্ধি পেলেও, বৃদ্ধি পায়নি লাগসই কোনাে প্রযুক্তি। হালের বলদ আর মই-লাঙল আজো দরিদ্র কৃষকের কৃষিকাজের প্রধান হাতিয়ার। তা ছাড়া বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে খাদ্যশস্য নষ্ট হয়।
খাদ্যসমস্যার প্রতিকার : আমাদের দেশের খাদ্য সংকট মােকাবেলার জন্য সরকার ও জনগণকে মিলিতভাবে উদ্যোগী হতে হবে। সরকারকে নিতে হবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং জনগণকে নিতে হবে উদ্যোগী ভূমিকা। সরকার ভূমিব্যবস্থাপনা ও কৃষিনীতি ঘােষণা করে কৃষিক্ষেত্রে লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষককে সহযােগিতা দিতে পারে। আমাদের দেশে এখনাে পনেরাে শতাংশ জমি অনাবাদি রয়েছে। এ সমস্ত জমিকে চাষের আওতায় এনে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানাে সম্ভব। অশিক্ষিত, দরিদ্র, গ্রামীণ কৃষককে প্রশিক্ষণ দান ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক, মাটির উর্বরাশক্তি আর গুণাগুণ সম্পর্কে কৃষককে সচেতন করে তুলতে হবে। এ ছাড়া কৃষিজাত পণ্য বাজারজাত করা ও ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে কৃষকের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কৃষক খাদ্যশস্য উৎপাদনে অধিক উৎসাহী হয়ে উঠবে।
দরিদ্র কৃষকই দেশের বিশাল জনগােষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণ করে। অথচ সেই দরিদ্র কৃষক সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। কৃষকের নেই কোনাে সামাজিক মর্যাদা। কৃষিক্ষেত্রে অর্থঋণের সুবিধাও খুব সীমিত। এ ছাড়া বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর দুর্গত এলাকার কৃষকদের সার, বীজ, কৃষিযন্ত্রপাতি ও অর্থসাহায্য দিয়ে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শুধু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করলেই হবে না। দরকার জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রােধ। এখনই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে লাগাম টেনে না ধরলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে খাদ্য সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। পরিসংখ্যানবিদদের ধারণা, ২০২০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় বিশ কোটিতে উন্নীত হবে। এ বিপুল সংখ্যক জনগােষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা কীভাবে পূরণ হবে, তা ভাবাই যায় না। সুতরাং এখনই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়ােজন।
উপসংহার : খাদ্য সমস্যা দেশের একটি মৌলিক সমস্যা। এ সমস্যা অবশ্যই সমাধানযােগ্য। তবে এর জন্য দরকার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, বাস্তবমুখী পদক্ষেপ এবং সরকার ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগী ভূমিকা। সরকার ইতােমধ্যে খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ইত্যাদি সংস্থা উচ্চ ফলনশীল নানা বীজ ও শস্যের উদ্ভাবন করেছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি উন্নয়নে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব প্রচেষ্টা সফল এবং বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যার সমাধান করা কঠিন হবে না।
Leave a comment