প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন

[ সংকেত: ভূমিকা; জলবায় সম্মেলন বা কোপ-২১; সম্মেলনের স্থান ও সময়; জলবায়ু সম্মেলন কেন; অভিনব চুক্তি কোপ-২১; প্যারিস চুক্তি ও পূর্বের চুক্তির পার্থক্য; অমিমাংসিত বিতর্ক; উপসংহার । ]

ভূমিকা : আমরা পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দা। পৃথিবীতে মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু বেঁচে থাকার জন্য একটি নির্দিষ্ট মাত্রার তাপমাত্রা থাকা প্রয়ােজন। কিন্তু দিন দিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে আবার কিছু কিছু দেশে তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে। ইতােমধ্যে হিমালয় পর্বতমালার বরফ গলতে শুরু করেছে। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশেও মাত্রাতিরিক্ত বরফ গলে যাচ্ছে । পৃথিবীর জলবায়তে লক্ষ করা যাচ্ছে নানা ধরনের পরিবর্তন। এ ধরনের সমস্যা নিয়ে এ পর্যন্ত কয়েকবার জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন’ (COP.21)।

জলবায় সম্মেলন বা কোপ-২১ : কার্বন নিঃসরণ কমাতে ধনী ও উন্নত দেশগুলাের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় ক্ষতিপবন দসত বেশকিছু চাওয়া নিয়ে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় জলবায়ু সম্মেলন বা কোপ-২১। ২০০৯ থেকে ২০১৫ মাঝে কেটে গেছে চয় বছর। চাওয়া ছিল একটাই, জলবায়ু পরিবর্তন রােধে সব দেশের একমত্য। অথচ পৃথিবীর কল্যাণে দেশগুলাের একমত হতে সময় লেগেছে পুরাে ছয় বছর। ডারবানের চাওয়া মিলল প্যারিসে। সম্মেলনটি নানা কারণে সফলতার মুখ দেখেছে। অন্তত ১৯৫টি দেশের ঐকমত্য নিঃসন্দেহে একটি বড়াে প্রাপ্তি। সব দেশ পরিবেশ রক্ষার দাবিতে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি চুক্তিতে আসতে পেরেছে এ সম্মেলনের মাধ্যমে। 

সম্মেলনের স্থান ও সময় : জলবায়ু সম্মেলন বা কোপ-২১ অনুষ্ঠিত হয়েছে ফ্রান্সের প্যারিসে। ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই সপ্তাহব্যাপী এ সম্মেলন চলে। 

জলবায়ু সম্মেলন কেন : গত কয়েক দশকে বিশ্বের তাপমাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা। বেড়ে যাওয়ায় ওজোনস্তরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি ভূ-পৃষ্ঠে চলে আসছে। এতে মানুষের ক্যানসার রােগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ায় মেরু অঞ্চলের বরফ গলা শুরু হওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ভূ-পৃষ্ঠের নিমাঞ্চল ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া এর প্রভাবে বৃষ্টিপাত কমে গিয়ে মরু অঞ্চলের সৃষ্টি হচ্ছে। বন্যা, ঝড়, জলােচ্ছ্বাসের মতাে প্রাকৃতিক দুর্যোগও গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার ফল। আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা করেছেন বর্তমান শতাব্দীর শেষভাগে পৃথিবীর সার্বিক আবহাওয়ামণ্ডলে ঘটবে ব্যাপক পরিবর্তন ও বড়াে ধরনের বিপর্যয় । সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থা যা হবে, তা হলাে— উচ্চ পর্বত শিখরে, মেরু অঞ্চলে পুঞ্জীভূত বরফ গলে সাগর ও মহাসাগরের পানি ফাঁপিয়ে তুলবে। তলিয়ে যাবে অনেক শহর, বন্দর ও জনপদ। জলবায়ুর এরকম দ্রুত পরিবর্তনের জন্য পৃথিবীর সব দেশের মানুষই দায়ী। তবে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলােই এর জন্য বেশি দায়ী। তাই বিশ্বের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য। ‘জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আর এ সম্মেলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ ঐকমত্য হয়। 

অভিনব চুক্তি কোপ-২১ : প্যারিস জলবায়ু চুক্তিটি একটি অভিনব চুক্তি। এ চুক্তির অভিনবত্ব বুঝতে হলে নজর দিতে হবে এর আগে। জলবায়ু সম্মেলনে হওয়া চুক্তিগুলাের দিকে। ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়ােটোতে এমন এক জলবায়ু সম্মেলনেই ‘কিয়ােটো প্রটোকল’ স্বাক্ষর হয়েছিল। ওই চুক্তিতে ১২৯টি দেশ সমর্থন দিয়েছিল। তবে ওই চুক্তি থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে কানাডা তাদের সমর্থন। প্রত্যাহার করে নেয়। চুক্তিতে স্বাক্ষর ছিল না আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের । তাই চুক্তিটি বাস্তবায়নে পদে পদে বাধা এসেছে। কিয়ােটো। প্রটোকল’-এর পর প্যারিস চুক্তিই প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা সমাধানে বিশ্বনেতারা ঐকমত্য। প্রকাশ করলেন । প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন বা কোপ-২১ সম্মেলন শেষ হওয়ার পর বিবিসি (BBC)-র বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা। হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন রােধে পদক্ষেপ নিতে এই সম্মেলনেই প্রথমবারের মতাে পদক্ষেপগুলাে বৈশ্বিক স্তরে পৌঁছেছে। এছাড়া। লক্ষ্যমাত্রায় কীভাবে পৌছানাে যেতে পারে, তার একটি রূপরেখাও আছে চুক্তিতে, যদিও সেই কর্মপরিকল্পনার ভাষা বেশ দুরূহ। 

প্যারিস চুক্তি ও পূর্বের চুক্তির পার্থক্য : জলবায়ু সংক্রান্ত আগের চুক্তিগুলাের সঙ্গে প্যারিস চুক্তির প্রধান পার্থক্য হলাে এর। ব্যাপ্তিকাল। এতে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্বল্পকালীন লক্ষ্য। হিসেবে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে চুক্তিতে অনুমােদন দেওয়া দেশগুলাে কার্বন নির্গমন নির্দিষ্ট সীমায় নামাতে হবে। শুধু তাই নয়, ৫ বছর পরপর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যেসব দেশ তাদের লক্ষ্য পূরণ করতে না পারবে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। এছাড়া এবার প্যারিস চুক্তি দেখাশােনার ভার পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল (UNIPCC)-এর ওপর । আর সেক্ষেত্রে ওই প্যানেলের লক্ষ্য থাকবে, বর্তমান শতাব্দীর শেষ নাগাদ কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা। বিেশ্বক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ চুক্তি মূলত একটি আইনগত ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। এ চুক্তির ভিত্তিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে ধনী দেশগুলোর সাহায্য করবে । উন্নয়নশীল দেশগুলাে শুধু একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পরই এ চুক্তি মেনে চলতে বাধ্য হবে। তবে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলাের ওপর কোনাে বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি।

অমীমাংসিত বিতর্ক : প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনেও জলবায় পরিবর্তন নিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলাের সঙ্গে উন্নত দেশগুলাের মতবিরোধ পুরোপুরি ঘুচেলি। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের সমুদ্রোপকূলীয় দেশগুলাে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে করণীয় নিয়ে এখনও অনেক বিতর্কের সমাধান হয়নি। মালদ্বীপের পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিক এবং দেশটির প্রেসিডেন্টের সাবেক উপদেষ্টা মাশনাল প্যারিস চুক্তিতে খটকা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তাছাড়া সম্মেলনে যােগ দেওয়া সব দেশ এখন পর্যন্ত খসড়া চুক্তির অনুমােদন দেয়নি। উল্লেখ্য যে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অনেক দ্বীপপুঞ্জ আছে, যেগুলাে মাত্র ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লেই পুরােপুরি পানিতে ডুবে যাবে। তাই প্যারিসে যখন ঠিক হয়েছে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে, তখন ধরেই নেওয়া যায় ভবিষ্যতে এসব দ্বীপের বাসিন্দাদের ভালাে কিছুর আশা নেই। এছাড়া ডুবতে বসলে সেখান থেকে কীভাবে তাদেরকে নিয়ে আসা হবে এবং কোথায় পুনর্বাসন করা হবে এ ধরনের কোনাে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। এর পাশাপাশি জলবায়। পারবতন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিতে উন্নত দেশগুলাের সরকারে যারা থাকবেন তাদের কর্তৃত্বও আগের মতােই বজায় থাকছে। ফলে আমেরিকার মতাে দেশে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে স্বয়ং সিনেটই দ্বিধাবিভক্ত, সেখানে গঠনমূলক কোনাে পদক্ষেপ আসার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। সংবাদ বিশ্লেষণধর্মী ওয়েবসাইট টুথডিগে প্রকাশিত এক নিবন্ধে কোপ-২১ সম্মেলনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলা হয়েছে, কার্বন নিঃসরণ ইস্যুতে লক্ষ্য যা হওয়া উচিত ছিল, তার মাত্র ৬৬ শতাংশ পূরণ করতে পেরেছে এই সম্মেলন। এর অর্থ হলাে নিজেদের সামান্য সুবিধার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের কাধে বিশাল এক বােঝা তুলে দিচ্ছি আমরা। 

উপসংহার : জলবায়ুর পরিবর্তন যেভাবে হচ্ছে তাতে মানুষের বেঁচে থাকা এমনকি পৃথিবী নামক গ্রহের টিকে থাকা নিয়ে অনেকে। শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মানবজাতির আবাস এ পৃথিবী নামক গ্রহের ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা একটু হলেও ভাবেন, তারা কোপ-২১ সম্মেলন। চলাকালে চোখ খােলা রেখেছিলেন। ১২ ডিসেম্বর, ২০১৫ কাউকে হতাশ না করেই অভূতপূর্ব এক চুক্তির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ আয়ােজিত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন। বিভিন্ন কারণেই জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার ক্ষতিকর দিকগুলাে মােকাবিলায় মানবজাতির সমন্বিত প্রচেষ্টার ইতিহাসে এ সম্মেলন অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কেননা, এবার দীর্ঘদিনের অচলায়তন ভাঙা সম্ভব হয়েছে। একেবারে নৈরাশ্যবাদীরাও বলেছেন, ভিন্ন কিছু আছে এবারের চুক্তিতে। যদিও শেষ পর্যন্ত কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আমরা আশা করছি, বিশ্বের উন্নত, উন্নয়শীল ও অনুন্নত সকল দেশের মানুষ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করলে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাস করে এ পৃথিবীকে বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযােগ্য করে তােলা সম্ভব হবে।