আমার প্রিয় শখ বা শখের কাজ

সূচনা : কোনাে লাভক্ষতি বিবেচনা না করে শুধুই নির্মল আনন্দের জন্য মানুষ যা করে তাকে শখ বলা যেতে পারে। প্রয়ােজনের তাগিদে মানষ নানারকম কাজ করে। শিক্ষার্থীদের প্রধান কাজ ও কর্তব্য লেখাপড়া করা। মানুষ কর্তব্য কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কিংবা কর্তব্য কাজের বাইরে কিছু কিছু কাজকে বিশেষভাবে পছন্দ করে পছন্দ করে সেই কাজের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে কিংবা ওই কাজ করে আনন্দ পায় এ ধরনের কাজকে বলে শখের কাজ , ইংরেজিতে বলে ‘হবি’ (Hobby)। 

নানারকম শখ : শখ নানা রকম হতে পারে। শিল্পী হতে না পারলেও কেউ কেউ শখ করে গান গায়, বাদ্যযন্ত্র বাজায়। আবার কেউ কেউ নতুন নতুন কাপড় পরে নানা সাজে ঘুরে বেড়ায়। এ ধরনের শখকে প্রকৃতপক্ষে শখের মধ্যে ফেলা যায় না। কেননা এ ধরনের শখের কাজের কোনাে সার্থকতা নেই, অর্থ নেই। মন যা চাইল তাই করাকে শখ বলা যায় না। শখ মানুষকে নির্মল আনন্দ দেবে, সে কাজের প্রতি তার আগ্রহ ও উৎসাহ দিন দিন বৃদ্ধি পাবে। সে কাজের মধ্য দিয়ে সে এর সার্থকতা খুঁজে পাবে। উদ্দেশ্য ও অর্থহীন কাজে কোনাে সার্থকতা নেই। তাই মানুষ শখের বিষয় নির্ধারণেও কিছুটা বিবেচনা করে থাকে। যেমন : কেউ শখ করে ছবি আঁকে, ডাক টিকিট সংগ্রহ করে, কেউবা বই সংগ্রহ করে, কেউ-বা পড়ে বই, কেউ বাগান করে, এমনকী কেউ কেউ শখ করে নাচও শেখে। এ কাজগুলাে শখের বিষয় হলেও এ ধরনের কাজের মধ্যে সার্থকতা আছে বলেই মানুষ আনন্দ পায়, আর একে শখের কাজ হিসেবে গ্রহণ করে।

আমার শখের কাজ : আমার শখের কাজ বাগান করা। গ্রামে থাকি বলে বাগান করার পর্যাপ্ত সুযােগ আমার রয়েছে। আমাদের বাড়ির আঙিনার অনেক জায়গাই পতিত পড়ে থাকে। কোনাে কাজে লাগে না। আমি সেরকম একটু জায়গাই বেছে নিয়েছি বাগান করার জন্য। প্রথমে ফুলের বাগান করার উদ্দেশ্যে নানা জাতের ফুল গাছ লাগিয়েছি। একটাকা দুটাকা জমিয়ে কখনাে বাবাকে দিয়ে, কখনাে-বা বড়াে ভাই কিংবা বন্ধকে অনুরােধ করে, কখনাে নিজেই উপজেলা শহর থেকে ফুলের গাছ সংগ্রহ করেছি। দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুলের গাছে ভরে গেছে আমার বাগান। গােলাপ, বেলি, দোপাটি, গদা, গন্ধরাজ, ডালিয়া, কসমস, জই, চামেলি, জবা, হাসনাহেনা সবই আছে আমার বাগানে। আমার বাগানে সারা বছর ফুল ফোটে। ফুলের মউ মউ গন্ধে চারদিক ভরে ওঠে। শুধু একটি ফুলের বাগানের কারণেই আমাদের বাড়িটিকে আর এখন চেনা যায় না। সবার মুখে মুখে শধ ‘সন্দর’ কথাটি যেন শেখ আছে। আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। পাড়াপ্রতিবেশীর, ‘সুন্দরের কানাকানিতে, বাগানে মৌমাছি-ভ্রমরের গুঞ্জন আর পাখির কলরবে, আমার হৃদয়-মন নেচে ওঠে। আমি আনন্দে হারিয়ে যাই। এ আনন্দ কাউকে বলে বােঝাম নয়। আমার বাগানে পাখি গান গায়। সে এক অপরূপ দৃশ্য। রাতে যখন চাঁদের আলাে এসে বাগানে পড়ে তখন ফুলেরা হাসে। আমার মনে পড়ে সেই ছােট্টবেলার ‘কাজলা দিদি’ কবিতার কথা :

‘বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই-

মাগাে, আমার শােলক-বলা কাজলা দিদি কই? 

পুকুর ধারে, নেবুর তলে থােকায় থােকায় জোনাক জ্বলে-

ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই;

মাগাে আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?’ 

শখ করে বাগান করলেও বাগানই এখন আমার নিত্য সঙ্গী হয়ে গেছে। লেখাপড়ার সঙ্গে আমার বাগানের সবকিছুই যেন মিলেমিশে একাকার। এই ধরুন বইয়ে কী আছে : সমাজের কথা, গাছের কথা, ফুলের কথা, ফলের কথা, কিংবা সংখ্যার কথা। এর সবই আমি আমার বাগানে খুঁজে পাই। বাগানের পাশেই আমার পড়ার ঘর। অনেক রাত অবধি আমি পড়ি। অপেক্ষায় থাকি হাসনাহেনা, গন্ধরাজ কখন আমার জন্য গন্ধ বয়ে আনবে। ততক্ষণে ঝিমােতে ঝিমােতে হয়তাে-বা ঘুমিয়ে পড়েছি। ভাের না হতেই দোয়েলের ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠে আমি আমার বাগানে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। ফুল দেখি, কলি দেখি, কোন ফুল কখন ফুটলাে তা দেখি। গাছে পােকা ধরেছে কিনা, কোনােটি পরিচর্যার অভাবে নেতিয়ে পড়েছে কিনা। আমি আমার বাগানের নিয়মিত পরিচর্যা করি। আবার এসে পড়তে বসি। এবার বার্ষিক পরীক্ষায় আমার রেজাল্ট খুবই ভাল হয়েছে। সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন বাবা। আমাদের বাড়ি থেকে উপজেলা শহর বেশ দূরে। বাবা পায়ে হেঁটে গিয়ে একটা শাল গাছের চারা নিয়ে এসে আমাকে উপহার দিলেন। বাবা না বললেও আমি বুঝতে পেরেছি বাগানে বেশি সময় দেয়ার জন্য বাবা একদিন আমাকে খুব বকেছিলেন। বাবার ভয় ছিল বাগান করতে গিয়ে পাছে আমি বেটি পড়ালেখায় পিছিয়ে যাই। বাপ-ছেলে মিলে পুকুর পাড়ে গাছটি লাগালাম। বাবা আমাকে বললেন, ‘দেখিস মা, এ গাছ একদিন অনেক বড়াে হবে, অ..নে…ক বড়াে। আমি না থাকলেও তাের পাশে এ গাছ বন্ধুর মতাে দাঁড়িয়ে থাকব। আর যদি কিছু নাও করতে পারে- যতদিন বেঁচে থাকবে ততােদিন সে দেবে নির্মল বাতাস, অক্সিজেন। আর অনেক বড়াে হয়ে দেবে টাকা। এরপর বাবা প্রায়ই . একটা দুটো করে নানা রকমের ফলের গাছ, কাঠ জাতীয় শাল-সেগুনের গাছ লাগিয়ে পুরাে বাড়িটাকে একটা বড়াে বাগান করে তুলেছে, আর একাজে আমি বাবার প্রধান সহায়। বাগানের সুবাদে, বলতে গেলে শখের বশেই বাগান। করতে গিয়ে গাছের নানা উপকারের কথা আমি জানতে পেরেছি। গাছ আমাদের নীরব বন্ধু। সে আমাদের শুধু ফুল। ও ফলই দেয় না; পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে, ঝড়-ঝাপটা থেকে বাড়ি-ঘর রক্ষা করে। নানা ওষুধি গাছ। নানাভাবে আমাদের উপকারে আসে। আর অভাবের দিনে কিংবা বিশেষ প্রয়ােজনে গাছ কিংবা কাঠ বিক্রি করে আমরা যে উপকার পাই তাতে গাছকে বিশ্বস্ত বন্ধু না বলে উপায় আছে কী! 

উপসংহার : আমার প্রিয় শখ বাগান করা। বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়িতে যদি অন্তত একজনের এরকম বাগানের শখ থাকে, তবে বাংলাদেশ একটি মস্ত বড়াে বাগানে পরিণত হবে। এর সৌরভে পৃথিবী আমােদিত হবে। এরপ একটি বাংলাদেশের অপেক্ষায় রইলাম।