পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার সম্পর্কে একটি টেলিভিশন ভাষণ তৈরি কর।
অথবা, বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে ‘পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার’ শীর্ষক একটি ভাষণ । 
অথবা, ‘দূষণমুক্ত পরিবেশ চাই’ শীর্ষক সেমিনারে একজন ছাত্র/ছাত্রীর ভাষণ তৈরি কর । 

[আজকের এ আয়োজনের শ্রদ্ধাভাজন সভাপতি, সম্মানিত প্রধান অতিথি, বিজ্ঞ আলোচকবৃন্দ ও উপস্থিত সুধীমণ্ডলী- শুরুতেই আপনাদের আমার সশ্রদ্ধ সালাম ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি ।]

প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, আপনাদের প্রতি আমার অকৃত্রিম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রইল।
এ সময়োপযোগী আলোচনায় দুকথা বলার সুযোগ হবে এমনটি কখনোই ভাবিনি; বিশেষ করে সভাপতি মহোদয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমার এ উপস্থিতি— অনেকটা বড়ো পাওয়া হিসেবে নিচ্ছি। একুশ শতক এক উন্নয়নের স্মারকবার্তা, অভাবিত অগ্রগতির এক নতুন ঠিকানা, পৃথিবীতে আর্থনীতিক প্রবৃদ্ধির এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক । কিন্তু আমাদের অফুরন্ত সম্ভাবনাকে পদদলিত করে যে পরিবেশ বিপর্যয় চলছে, তার খবর আমরা কতটুকুই বা রাখি । পৃথিবীর ওজোনস্তর ক্রমাগত ক্ষয়ে যাচ্ছে । মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া এবং উন্নত রাষ্ট্রগুলোর সীমাহীন কার্বন নিঃসরণ- আজ কেতাবি বিদ্যার মতো শুনালেও বড়ো আতঙ্কের মধ্যে আমরা বসবাস করছি ।

প্রিয় সুধী
আপাতত আমাদের সুখী মনে হলেও আমরা কি সুখের প্রকৃত সন্ধান পেয়েছি; বরং প্রতিনিয়ত পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্লেদাক্ততায় আমাদের নাভিশ্বাস চরমে উঠতে যাচ্ছে । প্রতিনিয়ত গাড়ি-বাড়ি আর ইমারতের প্রতিযোগিতায় একের পর এক বৃক্ষনিধন করেই চলছি । জনসংখ্যার ঘনত্বের আধিক্যে বেসামাল হয়ে পড়েছে মানুষ । তাই ফসলি জমিতে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের বাড়ি, রাস্তা- ঘাট ইত্যাদি । ফলে অনেককাল ধরেই যে বৃক্ষ-লতা-গুল্ম আপন ঔদার্যে আমাদের বিতরণ করেছিল অপরিমেয় জীবনীশক্তি; আজ নির্মম সভ্যতায় তাদের বলি হতে হয়েছে ।

প্রিয় সুধীবৃন্দ
নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদীর বেহাল দশা পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণে পরিণত হয়েছে । প্রবহমান নদীর নাব্যতাকে শুধু নিজের স্বার্থে নির্মমভাবে ব্যবহার করে, বাঁধ দিয়ে, দখল করে, ময়লা-আবর্জনা কলকারখানার বর্জ্য ফেলে নানাভাবে দূষিত
করা হচ্ছে।

সম্মানিত সুধীমণ্ডলী
শুধু নদীর প্রতি জুলুম নয়, বরং নির্বিচারে বন-জঙ্গল ধ্বংস, গাছপালা নিধন, পশুপাখি শিকার সবকিছুরই নেতিবাচক প্রভাব আমাদের পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। জীবনের সঙ্গে গাছপালার যে ওতপ্রোত সম্পর্ক সেখানে এরূপ নিধনযজ্ঞ অবশ্যই প্রকৃতির সহ্য করার কথা নয়। তাই প্রচণ্ড খরায় একদিকে যেমন ফসল পুড়ে ছাই হয়ে যায়, অন্যদিকে প্রবল বন্যা প্রকৃতিকে ভারসাম্যহীন এক পাগলাটে ঘোড়ায় পরিণত করছে ।

প্রিয় সুধীমণ্ডলী
বর্তমানে সারা বিশ্ব পরিবেশ সংকটের চরম পর্যায়ে উপনীত । মানুষ সচেতন কিংবা অচেতনভাবেই পরিবেশের এই সংকট তৈরি করেছে । ফলে মানুষের পৃথিবী আজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে ।

সম্মানিত সুধীবৃন্দ
বিশ্বব্যাপী পরিবেশ বিপর্যয়ের এ সন্ধিক্ষণে আমাদের অবস্থা আরও করুণ । দেশের রাজধানী শহর ঢাকা, আজ বলা যায় শতভাগ দূষিত একটি নগরী । প্রতিনিয়ত কার্বন আর সিসা নিঃসরণে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের নানা ধরনের রোগসহ ভয়াবহ ক্যানসারের দিকেই ধাবিত হচ্ছে । প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাসের এ নগরীতে নেই কোনো ভালো গণশৌচাগার, যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ, আবর্জনার স্তূপ আমরা দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাই; এরপর কি আর কিছু বলার থাকে । বহুল আলোচিত ট্যানারি শিল্প আজও স্থানান্তরিত হয়নি বরং নগরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নানা শিল্পকারখানা আজও প্রচণ্ড দানবের মতো দাঁড়িয়ে সর্বক্ষণ পরিবেশকে করছে দূষিত।

প্রিয় সুধীবৃন্দ
অপ্রিয় হলেও সত্য এসব শিল্পকারখানার মালিকরা যেমন ধনাঢ্য তেমনি ক্ষমতাশালী হওয়ায় সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও এদেরকে একচুলও নড়ানো যায়নি । অথচ এসব মুখোশধারীরা সভা-সমিতিতে গলা ফাটিয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা বলে । এ প্রিয় নগরীতে আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিসহ কত জ্ঞানী, গুণী, মনীষীরা বসবাস করেন । দু’একটি উদ্যোগ ছাড়া পরিবেশ বিপর্যয়ের টেকসই কোনো ব্যবস্থা আজও গৃহীত হয়নি। এখনও নিরন্ন-বস্তিবাসী মানুষ রাস্তায়, ড্রেনে কিংবা খোলা আকাশের নিচে মলমূত্র ত্যাগ করে । অথচ আমরা তাদের জন্য কিছু করতে পারিনি ।

সম্মানিত ভাই ও বোনেরা
দামি ফ্ল্যাট বাড়ি আর গাড়ি থাকলেও আপনার সুরম্য প্রাসাদের পাশেই যে নর্দমা, ঢাকনা খোলা ড্রেন কিংবা একটু দূরেই যে বস্তি, প্রতিনিয়ত শব্দ দূষণ, ধুলোবালি এর হাত থেকে বাঁচার উপায় কী?

প্রিয় সুধী
পূর্বেই উল্লেখ করেছি পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য আমরা কম-বেশি সকলেই দায়ী । তবে শুধু বড়ো বড়ো শহর কিংবা রাজধানীতে নয় বরং আমাদের অস্তিত্বের ভিত যে গ্রামগুলো সেখানেও পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে যত্র-তত্র । মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহারে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী নানা প্রাণী আজ চিরতরে বিলুপ্ত । গ্রামে নানা আর্থনীতিক প্রকল্পের নামে পুকুর-বিলে যেসব কৃত্রিম মৎস্য খামার করা হচ্ছে, সেখানেও নানা রাসায়নিক দ্রব্যাদির ব্যবহার বেড়েই চলেছে । এছাড়া অতি দ্রুত বর্ধনশীল এবং পরিবেশ বিপর্যয়কারী নানা বৃক্ষ যেমন ইউক্যালিপটাসের রোপণ রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে । গ্রামীণ উন্নয়নের নামে চলছে হাঁসের খামার, মুরগির খামার, গরুর খামার কিংবা মাছের খামার। এখানকার নানা ধরনের ময়লা অপসারণ আজও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠেনি । এছাড়াও এখনো গ্রামের অসংখ্য মানুষ খোলা আকাশের নিচে তাদের প্রাকৃতিক কাজ সারতে পছন্দ করে । এজন্য যথেষ্ট সচেতনতাও গড়ে ওঠেনি ।

সম্মানিত দেশবাসী
গ্রাম কিংবা শহর এমন কোথাও নেই যে পরিবেশ বিপর্যয় হয়নি । তবে শহরের তুলনায় এখনো গ্রাম অনেকটা নিরাপদ রয়েছে । কিন্তু বিশ্বে পরিবেশ বিপর্যয়ের যে চিত্র তা আমাদেরকে মোটেই স্বস্তি দিচ্ছে না; বরং এক গভীর অশনি বার্তাই বহন করছে ।

সুপ্রিয় সুধীমণ্ডলী
গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া বর্তমান বিশ্বে একটি বহুল আলোচিত বিষয়। গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়ার ফলে আগামী কয়েক দশকে আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে। ফলে অনাবৃষ্টি, বনাঞ্চলে অগ্নিকাণ্ড, তাপমাত্রা বৃদ্ধি, হ্যারিকেন, সাইক্লোন, খরাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। অনেক বিজ্ঞানী উল্লেখ করেছেন যে, গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে তাপমাত্রা ২-৫ ডিগ্রি সে. বৃদ্ধি পেলে পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হবে । আমাদের উপকূল অঞ্চলের প্রায় এক- তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত হতে পারে ।

প্রিয় সুধীমণ্ডলী
জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে গতবছর ১১ ডিসেম্বর শনিবার প্যারিসের স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় বিশ্বনেতৃবৃন্দ এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হন । এতে ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার বিষয়ে বাধ্যতামূলক চুক্তি অনুমোদিত হয় । তবে নানাবিধ কারণে সচেতনমহল এই চুক্তিতে পুরোপুরি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছে না । এ ছাড়াও বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হিসেবে খ্যাত আমেরিকার সিনেটেই এ নিয়ে মত-বিরোধ রয়েছে। তথাপি আমাদের সরকার এ বিষয়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে; এ এক আশার কথা ।

প্রিয় দেশবাসী
বাঙালি কখনোই আশাহত হয় না । ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, ব্রিটিশ বিদ্রোহ, পাকিস্তানি শাসন-শোষণ প্রভৃতিকে পরাস্ত করে এদেশ আজ প্রতিষ্ঠিত । তেমনি এক অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের চিরচেনা সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশকে আজ সবুজে শ্যামলে ভরিয়ে দিতে হবে; খেতে-খামারে যতদূর সম্ভব প্রাকৃতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে; পরিবেশের বিপর্যয় রক্ষায় এক ইস্পাত দৃঢ় জনমত গড়ে তুলতে হবে । সর্বোপরি সকল প্রকার পরিবেশ বিপর্যয় থেকে সোনার বাংলাকে বাঁচাতে হবে । আসুন কবি গুরুর সেই বীজমন্ত্রে আমরাও দীক্ষিত হই—

দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর ।

আসুন শুধু নগর নয় বরং জীবনের প্রয়োজনে নগরের পাশে অরণ্য তথা সবুজের ব্যূহ দিয়ে পরিবেশকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করি । এতক্ষণ আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলার সুযোগ দানের জন্য আয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে এখানেই শেষ করছি । সবাইকে ধন্যবাদ ।