শরতের প্রভাত

[ রচনা সংকেত : ভূমিকা, শরতের আগমন, শরতের বৈশিষ্ট্য, বর্ণনা, উপসংহার। ]

ভূমিকা : ষড়ঋতুর আবর্তনের ফলে প্রকৃতির বুকে সৌম্য-শান্ত শরতের আবির্ভাব ঘটে। বর্ষার তাণ্ডব নৃত্য যখন শেষ হয়ে যায়, তখন শিশির ভেজা পায়ে সে এগিয়ে আসে। শরতের আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। সকালে কুয়াশা . জমে। চারপাশে আবছা, ঘোলা আয়নার প্রতিবিম্বের মতন এ দৃশ্য। ঘাস, শুকনো ঝরাপাতা ভিজে সপসপে ー সারা রাতের . শিশিরে। সারা রাতে ঝরে পড়া শিউলির উপর বিন্দু বিন্দু জমে থাকে শিশির। সূর্যের আলোয় তা মুক্তার মতো চিক চিক করতে থাকে। কবির ভাষায়ー

“আজ প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখানি 

তাই ভোরে উঠেছি,
আজ শুনতে পাব প্রথম আলোর বাণী
তাই বাইরে ছুটেছি।”

শরতের আগমন : ঋতুচক্রে বর্ষার বিদায় ঘণ্টা বাজতে থাকে ঠিক একই সাথে আগমনী গান শোনা যায় শরতের। সমস্ত প্রকৃতি শরৎ সুন্দরীর আগমনের আয়োজন করতে থাকে। নিঃশব্দে কখন যে শরত আমাদের মাঝে এসে পড়ে তা বোঝাই যায় না। অথচ প্রত্যুষে ঘুম থেকে উঠে যখন দেখা যায় ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু মুক্ত দানার মত ঝলমল করছে তখনই বুঝতে বাকি থাকে না শরৎ সুন্দরীর আগমন প্রকৃতিতে ঘটেছে । কবির ভাষায় ー

“শিশির সিক্ত শেফালী ফুলের ঘন সৌরভে মাতি
শরৎ প্রভাতে সখিগণ সাথে আনিয়াছি মালা গাঁথি।”

শরতের বৈশিষ্ট্য : হালকা কুয়াশা আর ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু শরতের সলজ্জ উপহার। এ যেন কোন আনন্দাপুত হৃদয়ের খুশির ঝলক। শরতের প্রভৃতে কুমুদের সৌন্দর্য সকলকে বিমোহিত করে। নদীর তীরের কাশবন ফুলে ফুলে সাদা হয়ে যায়। মৃদু বাতাসের দোলায় আন্দোলিত কাশবন এক অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। স্নিগ্ধ সূর্য কিরণ চারদিকে আলোকিত করে। নীলাকাশের এক জুড়ে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। সুনীল আকাশের ছায়া পড়ে শান্ত নদীর বুকে। নদীতে প্রায় পানি শুকিয়ে যায়। বকগুলো হাঁটুজলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। নদীর এখানে ওখানে ছোট ছোট চর জেগে ওঠে। কবির ভাষায় ー

“সাদা সাদা বক কনেরা রচে সেথায় মালা 

শরতকালে শিশির মানিক জ্বালায় সেথা আলো।”

বর্ণনা : হালকা কুয়াশা আর বিন্দু বিন্দু জমে উঠা শিশির, শরৎ প্রভাতের প্রথম সলজ্জ উপহার। এ যেন কোন বিরহীর বেদনার্ত হৃদয়ের ঝরে পড়া অশ্রুকণা। শারদ প্রভাতে মোরগ ফুলের মতো লাল হয়ে ওঠে পূর্বাকাশ। শান্ত নদীর কোল ঘেঁষে ফুটে থাকে অজস্র কাশফুল। মৃদু বাতাসের দোলায় আন্দোলিত হয় কাশবন। স্নিগ্ধ সূর্যকিরণে মাঠ-ঘাট ঝলমল করে। সুনীল আকাশের ছায়া পড়ে শান্ত নদীর বুকে। দু’একটি ছোট মাছ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে প্রাণ চাঞ্চল্যের পরিচয় দেয়। হাঁটু জলে সাদা সাদা বক নিবিষ্ট মনে দাঁড়িয়ে থাকে। নদীর এখানে সেখানে ছোট দ্বীপের মতো চরগুলো সূর্য কিরণে জেগে ওঠে।

প্রভাতের শিশির ভেজা শেফালি ফুল অনুপম সৌন্দর্য নিয়ে ঘাসের বুকে হাসে। আকাশে বাতাসে আর দূর্বা ঘাসে শরত্রাণী তার স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দেয়। সহজ অনাড়ম্বর রূপের মাঝে কী যে এক আশ্চর্য মোহনীয়তা ফুটে ওঠে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ফুলের বনে ভ্রমরেরা মধু খাওয়ার লোভে উড়ে বেড়ায়। নদীরকূলে বসে সখাসখির মেলা। পাখিরা আনন্দে গেয়ে ওঠে, তাই দেখে মানুষ বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে পড়ে। কবির হৃদয়ে তখন জেগে ওঠে বন্দনা সংগীত ー

“আজিকে তোমার মধুর মুরতি 

হেরিনু শারদ প্রভাতে।

হে মাতঃ বঙ্গ। শ্যামল অঙ্গ

ঝলিছে অমল শোভাতে।”

শারদ প্রভাতের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে সাধারণ মানুষও মুগ্ধ হয়। কবির চোখের মতো নিটোল সৌন্দর্য-পর্যবেক্ষণ দৃষ্টি হয়ত তাদের নেই, কিন্তু তবুও তাদের হৃদয়ে জেগে ওঠে নানান ভাব। সুনীল আকাশের এখানে ওখানে বৃষ্টিহীন মেঘগুলোকে ভেসে বেড়াতে দেখে তারা উদাসীন হয়। আর এ সৌন্দর্য কবির চোখে অঞ্জন মেখে দেয়। শারদ প্রভাতের অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে সে রচনা করে কবিতা, রচনা করে গানー

“আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো

আমার নয়ন হতে আঁধার মিলালো মিলালো।”

অনেকে বসন্তকে শ্রেষ্ঠ ঋতু মনে করলেও শরৎ আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। শরৎ যেন নিয়তই খুশিতে ভরপুর। বর্ষার পরেই। আসে স্নিগ্ধ শরৎ। শরৎ আসে মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি খেলতে খেলতে। একটু মেঘ, এক পশলা বৃষ্টি, এক ঝলক হাওয়া পরক্ষণেই সোনালি রোদ্দুর এ হলো শরতের রূপ। শরতের ছবিটি ভীষণ মনোরম। বর্ষার ঘনঘোর আঁধার এ সময় থাকে না। শরতের সকাল মেঘের কোল ভেদ করে পূর্বাশার দুয়ার আলোকিত করে আগমন করে।

শরতে সরোবরে পদ্মের সাথে হৃদয় মেলে দিয়ে ফুটে ওঠে বাংলাদেশের প্রাণ। বাংলাদেশ আপনার হৃদয়কে আমাদের কাছে উজাড় করে দেয় এ শরতে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। বাংলাদেশের মানুষের আনন্দ, উৎসব, ঐশ্বর্য নির্ভর করে ফসলের ওপর। শরৎ নিয়ে আসে আগাম ফসলের বার্তা।

শরতে ভাবুক মানুষকে সীমাহীন ভাবালোকে নিয়ে যায়। তাদের মন চলে যায় এক কল্পনা জগতে। শুভ্র মেঘের সাদা পাল উড়িয়ে মন খুঁজে ফিরে কোথায় কোন রঙিন সীমানায়। তখন মনে হয় ভাটাপড়া নদীর মৃদু স্রোতে নদীর এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ছুটে বেড়ায়। শরতের প্রভাতে কেবলই উদাস করা হাতছানি। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার আমন্ত্রণ। শরৎ তাই ছুটির ঋতু, অবকাশের ঋতু।

শরৎ সকালে একটু একটু শীত অনুভূত হয়। হেমন্ত পেরিয়ে শীত আসবে এ যেন তারই পদধ্বনি। কুয়াশার রহস্যজাল কাটিয়ে চনমনে রোদ আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে আকাশে। সবুজ শস্যক্ষেত্রে ঝলমলে রোদ এসে মিষ্টি চুম্বন এঁকে দেয়। কবির বর্ণনা ー

“মাঠে মাঠে পুলক লাগে 

ছায়ানটের নৃত্যরাগে।”

শারদ প্রভাতে সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে ফুটে থাকে সাদা সাদা কাশফুল। ছেলেমেয়েরা খুব ভোরে ওঠে আঁচল ভরে কুড়ায় শেফালী ফুল। সেই ফুল দিয়ে তারা মালা গাঁথে। ফুলের স্নিগ্ধ সৌরভে মন ভরে যায়। নবীন ধানের মঞ্জরীতে তখন লাগে স্নিগ্ধ বাতাসের দোলা। শারদ প্রভাতের এ অপূর্ব সৌন্দর্যকে কবি তুলে ধরেছেন এভাবে ー

“আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ

আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা

নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে 

সাজিয়ে এনেছি ডালা। ”

উপসংহার : শরতের স্নিগ্ধ রূপ আমাদের সাহিত্যেও ঠাঁই করে নিয়েছে। শারদ সকালের অপূর্ব সৌন্দর্য নিয়ে লেখা হয়েছে বহু কবিতা, বহু গান। আবহমান বাংলার চিরায়ত রূপে শারদ প্রভাত জাগায় ভিন্ন ব্যঞ্জনা, যা অমলিন-অবিনশ্বর। আধুনিক কালের এ যান্ত্রিক সভ্যতার অভিঘাতে পুরনো মূল্যবোধগুলো বিসর্জিত হচ্ছে। আমাদের চিন্তাধারায় পড়ছে নতুন প্রভাব। এ প্রভাব আমাদের সাহিত্যেও পড়ছে। তবুও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যাদের মনের খোরাক যোগায় তাদের দৃষ্টিতে, শারদপ্রভাত দেখা দিবে পরিপূর্ণ সৌন্দর্য নিয়েই।