চর্যাপদের ভাষা কি সান্ধ্যভাষা ? মতামত দাও।

উত্তর: বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে চর্যাপদ আবিষ্কার করেন এবং ১৯১৬ সালে তা প্রকাশ করেন। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে এর প্রাচীনত্ব নিয়ে কোনো বিরোধ না থাকলেও এর-ভাষা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিস্ত র মতপার্থক্য দেখা যায়। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ এর গানগুলো হেঁয়ালি ধরনের সাংকেতিক ভাষায় লেখা। এ প্রহেলিকাময় পদগুলো প্রতীক ও রূপকাশ্রিত। পদগুলোর বাইরের অর্থ অনেকটা সরল ও বোধগম্য হলেও সেগুলোর আড়ালে রয়েছে ধর্মীয় নানা আধ্যাত্মিক অর্থ। সে অর্থ বেশ জটিল ও দুর্বোধ্য। চর্যার গভীরতর অর্থের নেপথ্যে বিরাজিত সাধন তত্ত্বের রূপকার্থই প্রধান। সন্ধ্যার মতো আলো আঁধারের অস্পষ্টতায় রহস্যময় বা হেঁয়ালিপূর্ণ বলে এগুলোকে বলা হয় ‘সন্ধ্যাভাষা’ বা আলো- আঁধারী ভাষা। এ প্রসঙ্গে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন: “সন্ধ্যার ভায়া মানে ‘আলো আঁধারী ভাষা’। কতক আলো, কতক আঁধার, খানিক বুঝা যায়, খানিক বুঝা যায় না।” তবে ‘সন্ধ্যা’ অভিধাটি নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। পণ্ডিত প্রবোধচন্দ্র বাগচী ও বিধুশেখর শাস্ত্রীর মতে, এ ভাষার নাম ‘সন্ধাভাষা’ বা ‘সন্ধ্যাভাষা’ নয়। সম্+ধা-এ ব্যুৎপত্তি অনুসারে ‘সন্ধা’ কথাটি দিয়ে এমন ভাষা বুঝানো যায়, যার বিশেষ অভিসন্ধি বা অভিপ্রায় আছে। তাঁদের মতে, ‘সন্ধা’ নামটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কেননা, সিদ্ধাচার্যদের অভিপ্রায় বা অভিসন্ধি চর্যাগানের ভাবের মধ্যে নিহিত রয়েছে। এ সন্ধ্যাভাষার উদাহরণ নিম্নরূপ:

মূল শব্দঃ ডোম্বী, আলিকালি, গঙ্গা ।

সাধারণ অর্থঃ ডুমনী , স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ, একটি নদীর নাম, গ্রাম্য।

সন্ধ্যাঅর্থঃ নৈরাত্ম্যা , শ্বাস-প্রশ্বাস ।

চর্যাকারগণ তাঁদের ধর্মতত্ত্ব ও সাধনপ্রক্রিয়া দীক্ষিতজন ছাড়া অন্য সবার কাছে অবোধগম্য ও গোপন করার জন্য সম্ভবত সন্ধ্যাভাষার আশ্রয় নিয়েছিলেন। সন্ধ্যাভাষার কিছু নমুনা দেওয়া হলো: ক. ‘সোথে ভরিলি করুণা নাবী/রূপা থোই নাহিক ঠাবী।’ খ. ‘বলদ বিআইল গবিঅ বাঝে।’ গ. এক সো পদমা চউসট্টী পাখুড়ী।’ সন্ধ্যাভাষা এক ধরনের সাংকেতিক ভাষা, যা কেবল নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের দীক্ষিতজনদের মধ্যে প্রচলিত; সাধারণের জন্য তা বোধগম্য নয়। এ পদগুলোতে দীক্ষিতদের বোধগম্য রূপক-সংকেত ব্যবহৃত হয়েছে। কোনো কোনো রূপকের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে মূল শব্দকে। এ পদগুলোতে আপাতবিরোধী প্রহেলিকা ধরনের বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। এভাবে চর্যা রচয়িতারা তাঁদের সাধন সহায়ক নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি করেছিলেন। এ ভাষাকেই পণ্ডিতেরা অভিহিত করেছেন ‘সন্ধাভাষা’ বা ‘সন্ধ্যাভাষা’।