ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি 1600 খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই ভারতবর্ষে তাদের ব্যাবসাবাণিজ্যের পথ সুগম করতে সক্ষম হয়েছিল। তা সত্ত্বেও পরবর্তী প্রায় একশাে বছরেও তারা এদেশে শিক্ষা প্রসারের জন্য কোনাে উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যদিও 1698 খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে এদেশে বিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির ইউরােপীয় কর্মচারীদের সন্তান-সন্ততির শিক্ষার ব্যবস্থা করা, ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষার প্রসার নয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। 1765 খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করে এবং তারপরই তারা ভারতবাসীর শিক্ষার বিষয়ে উৎসাহ দেবার কথা ভাবতে শুরু করে। কিন্তু এই বিষয়ে কোনাে প্রকার দায়িত্ব গ্রহণে তারা পুরােপুরি অনিচ্ছুক ছিল। ওই সময় ভারতবাসী শিক্ষার দায়িত্ব কোম্পানি গ্রহণ করবে কি না সে বিষয়ে কোম্পানির ডিরেক্টর ও ভারতবর্ষে নিযুক্ত কোম্পানির আধিকারিকদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। একদিকে কোম্পানির ডিরেক্টররা ভারতবাসীর শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করে, অন্য দিকে ভারতবর্ষে নিযুক্ত কোম্পানির আধিকারিকরা কোম্পানিকে এই দায়িত্ব গ্রহণের জন্য চাপ দিতে থাকে। 1811 খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে সরকার যদি শিক্ষাক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ না করে, তাহলে এদেশে শিক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা লােপ পাবে। কোম্পানির শিক্ষা সম্বন্ধে ঔদাসীন্য ইংল্যান্ডের শিক্ষিত সমাজ এবং ভারতে আগত খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারাও তীব্রভাবে নিন্দিত হতে থাকে। এরূপ সমালােচনার সম্মুখীন হয়ে 1813 খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সনদ আইন পুনর্নবীকরণের সময় সর্বপ্রথম কোম্পানির শাসনাধীন অঞ্চলে ভারতীয়দের শিক্ষার ব্যাপারে যে কোম্পানি সরকারের দায়িত্বে আছে, তা স্বীকার করে নেওয়া হয়।

1813 খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টের 43নং ধারাটি শিক্ষা বিষয়ক ধারা নামেও পরিচিত। এই ধারায় বলা হয়- ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতবর্ষে সামরিক, অসামরিক ও শিল্পবাণিজ্যের খরচ এবং সরকারি ঋণ ও তার সুদের জন্য খরচ বহন করার পরে রাজস্ব কর ও লাভের আয় থেকে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত হবে, তার থেকে অন্তত কমপক্ষে প্রতি বছর এক লক্ষ টাকা শিক্ষিত ভারতবাসীদের অধিকতর শিক্ষালাভের উৎসাহদানের জন্য, সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়নের জন্য এবং ভারতবর্ষে ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলের জনগণের মধ্যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রবর্তন ও উন্নয়নের জন্য ব্যয় করাই হবে স-পরিষদ গভর্নর-জেনারেলের আইনসম্মত কাজ।

1813 খ্রিস্টাব্দের চাটার অ্যাক্টে মিশনারিদের শিক্ষাবিস্তারকে উৎসাহিত করার এবং ভারতের নিজস্ব প্রাচীন সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি ভূমিকার বিষয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়। 1813 খ্রিস্টাব্দের চার্টার অ্যাক্টে পাশ হওয়ার আগে কোম্পানি নানাভাবে মিশনারিদের শিক্ষাবিস্তারের প্রচেষ্টাকে বাধা দিয়েছে। কিন্তু এই আইনের 13 নং ধারায় বলা হয়েছিলভারতবাসীদের মধ্যে প্রয়ােজনীয় জ্ঞানের বিস্তার ও তাদের নৈতিক উন্নতির জন্য শিক্ষা প্রবর্তনে আগ্রহী যে-কোনাে সংস্থা বা ব্যক্তি ভারতবর্ষে যেতে পারবে ও সেখানে থাকতে পারবে এবং তাদের সব ধরনের সুযােগসুবিধা প্রদান করা হবে।

এই ধারাটিকে সরকারিভাবে শিক্ষাবিস্তারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এর আগে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরিচালিত সরকার কোনাে অর্থ মঞ্জুর করেনি।

এই ধারায় ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য বরাদ্দ অর্থ প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য ব্যয় করা হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তাই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সঠিক অর্থে কাজের কাজ কিছু হয়নি।

চার্টার অ্যাক্টের 13 নং ধারা তথা মিশনারি ধারাটিতে প্রত্যক্ষভাবে মিশনারিদের উল্লেখ না থাকলেও, তাদের ওপর কোম্পানির যে বিধিনিষেধ ছিল, তা উঠে যায়। ফলে পরােক্ষভাবে মিশনারিদের জয় ঘােষিত হয়। তারা বিনা বাধায় ভারতে প্রবেশের ও বসবাসের অধিকার পায়। ধর্মপ্রচার ও শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রেও অনেকটা স্বাধীনতা লাভ করে। এককথায়, এই ধারার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উভয় উদ্যোগই প্রতিষ্ঠা লাভ করে।