অংশ-1 : ভূমিকা: এই অংশে শিক্ষানীতি বিশেষজ্ঞরা শিক্ষা নীতি নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষানীতি ও তার ফলশ্রুতি সম্পর্কে এই অংশে আলোচনা করা হয়েছে। এই অংশে ব্যক্তির উন্নয়নে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তির রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন, অর্থনৈতিক ও কারিগরি বিদ্যার বিকাশ, গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলে মধ্যবর্তী ব্যবধান হ্রাস সম্পর্কে বলা হয়েছে।

➧ ভারতের সম্পদ হল মানুষ। পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তার উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে।

➧ মহিলাদের মধ্যে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির মাধ্যমে জনসংখ্যার হ্রাস ঘটাতে হবে।

➧ গ্রামের দুর্বল পরিকাঠামাের উন্নতি ঘটিয়ে শিক্ষার হার বাড়াতে হবে। শহরাঞ্চলের সঙ্গে গ্রামের যােগাযােগ সুদৃঢ় করতে হবে উন্নয়নের স্বার্থে। 

➧ শিক্ষার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক চেতনা ইত্যাদি জাগ্রত করতে হবে যাতে সুরাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন গড়ে ওঠে।

অংশ-2 : শিক্ষার উপাদান ও ভূমিকা :

2.1 : আমাদের জাতীয় অনুভূতিতে শিক্ষা হল সকলের জন্য। শিক্ষাই হল বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের মূলসূত্র।

2.2 : শিক্ষার সংস্কৃতি মূলক ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। শিক্ষা আমাদের অনুভূতিকে এবং জাতীয় সংহতি সম্পর্কে ধারণা স্বচ্ছ করে। আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবধারা ও স্বাধীন মানসিকতা গড়ে তােলার জন্য শিক্ষার ভূমিকা অনন্য। জাতীয় শিক্ষার জন্যই আমাদের সংবিধানে সযত্নে লিখিত সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয় সংহতি ও গণতন্ত্রের ফলশ্রুতি বিষয়ক ধারণা সকলের নিকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

2.3 : অর্থনৈতিক বিভিন্ন স্তরের বা বিভাগের অনুকূল জনশক্তির (Manpower) সরবরাহে শিক্ষার ভূমিকা অনন্য। শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই গবেষণা ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া পরিচালিত। তাই শিক্ষাই হল জাতীয় স্বনির্ভরতার স্তম্ভ স্বরূপ।

অংশ-3 : শিক্ষায় জাতীয় ব্যবস্থা :

3.1 : আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত মৌলিক সত্যের উপর ভিত্তি করেই জাতীয় শিক্ষা সম্পর্কিত ধারণা সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

3.2 : জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় এই কথা বলা হয়েছে যে, একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত জাতি-ধর্ম-অঞ্চল ও স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই সমমানের শিক্ষা লাভ করবে।

3.3 : জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা মূলত সমগ্র জাতির জন্য একটা সাধারণ শিক্ষা কাঠামোর কথা ব্যক্ত করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে (১০+২+৩) কাঠামোটি বর্তমানে দেশের প্রায় সর্বত্র গৃহীত হয়েছে।

3.4 : মৌলিক বা আবশ্যিক সাধারণ পাঠক্রমের (Core Curriculum) অন্তর্ভুক্ত হবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সাংবিধানিক কর্তব্য-সহ জাতীয় ভাবধারা বিকাশে সহায়ক অন্যান্য বিষয় নিয়ে। যেমন— ঐতিহ্য (সাধারণ সাংস্কৃতিক/কার্যভিত্তিক), গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, নারী-পুরুষের সমান অধিকার, পরিবেশের সংরক্ষণ, সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ।

3.5 : জাতীয় শিক্ষার একটি অপরিহার্য লক্ষ্য হল— আন্তর্জাতিক সমবায় ও বিশ্বশান্তি অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধারণাকে সুদৃঢ় করা।

3.6 : শিক্ষাক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে যাতে সকল ভারতীয় সমসুযোগ পেতে পারে— সেরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

3.7 : গবেষণা ও উন্নয়ন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এমন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে যেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ স্থাপিত হয়, যেন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলিতে সম্পদ ও শক্তি বিনিময়ের সুযােগ সৃষ্টি হয়।

3.8 : শিক্ষাগত কর্মসূচির রূপায়ণের উদ্দেশ্যে শিক্ষা-সম্পদের আদান প্রদান, বৈষম্য দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা ও সাক্ষরতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিজ্ঞানের গবেষণা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে যাতে প্রত্যেকের মনে জাতীয় দায়িত্বের অনুভূতি জেগে ওঠে সেদিকে লক্ষ দিতে হবে।

3.9 : ভারতের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার শক্তি বৃদ্ধিতে যেসব সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যেমন—UGC, AICTE, MCI, NCERT, NIEPA ইত্যাদির কর্মসূচিকে শক্তিশালী করা।

অংশ-4 : সাম্যের অনুকুলের শিক্ষা :

4.1 : নতুন শিক্ষানীতি বৈষম্য দূরীকরণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করবে।

4.2 : নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি ও নারী জাতির কল্যাণে শিক্ষার একটি উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা স্থিরীকৃত হয়, যার প্রভাবে নারী শিক্ষার উদ্যম ও উৎসাহ ত্বরান্বিত হবে।

4.3 : নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরে তপশিলি ও বর্ণহিন্দুদের এবং তপশিলি উপজাতি শিক্ষায় যে বৈষম্য রয়েছে, তার অবসান ঘটিয়ে সর্বত্র সকলের জন্য সমসুযোগের ব্যবস্থা করার উপর কেন্দ্রীয় দৃষ্টি নিবন্ধ করা হবে।

4.4 : ভারতে এমন অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে যারা চলতি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত অথবা অনগ্রসর। সাম্য ও সামাজিক ন্যায়নীতির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেই সব সম্প্রদায়ের প্রতি অধিক মনোযোগ দিতে হবে।

4.5 : জাতীয় শিক্ষানীতির অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হবে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীরা যে সাধারণ মনুষ্য সমাজের অংশীদার হিসেবে। সমন্বিত হতে পারে।

4.6 : শিক্ষা অজ্ঞতা ও নির্যাতন থেকে মানুষকে মুক্তির কৌশল শেখায়। আধুনিক যুগে এই শিক্ষা লেখা ও পড়ার সামর্থ্যকে নির্দেশ করে। কারণ লেখা ও পড়ার ক্ষমতা মানুষকে শিক্ষা লাভের ক্ষমতাবান করে। এখানে বয়স্কদের সাক্ষরতার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অভিব্যক্ত।

অংশ-5: বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার পুনর্গঠন :

5.1 : শিশু সংক্রান্ত জাতীয় নীতি শিশুদের উন্নয়নে বিনিয়োগের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। যেসব জনগোষ্ঠীর বংশধরকে শিক্ষায় প্রথম অংশগ্রহণ করছে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

5.2 : পুষ্টি ও স্বাস্থ্য, সামাজিক, শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও প্রাক্ষোভিক উন্নয়ন ইত্যাদি মৌলিক বিষয়ের স্বীকৃতি জানিয়ে ECCE (Early Childhood Care and Education) সমস্থা শিশুকল্যাণ কর্মসূচিকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রয়োগ করা যাবে।

5.3 : প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত নতুন নীতি দুটি বিষয়ের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। যথা— (১) সমস্ত ছেলে মেয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি করা ও ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের শিক্ষার রাখা। (২) শিক্ষার গুণগত মানের প্রকৃত উন্নয়ন করা।

5.4 : স্কুলছুট ছাত্রছাত্রী, স্কুলবিহীন অঞ্চলের শিশুরা যারা স্কুলে যেতে না পেরে কাজ কর্মে নিয়োজিত, এরূপ শিশুৰ্মী ও গৃহকর্মে নিযুক্ত মেয়েদের জন্য বৃহদাকারে এবং বিধিবদ্ধ কর্মসূচি-সহ বিধিমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হবে।

5.5 : মাধ্যমিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, মানবিক বিষয় ও সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন ভূমিকার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। শিক্ষার্থীদের মনে ঐতিহাসিক চেতনা, জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি, নাগরিক হিসেবে সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভের সুযোগ সৃষ্টি করবে মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর। 

5.6 : প্রতিভাবান অথবা বিশেষ যোগ্যতা সম্পন্ন শিশুদের বিকাশ সাধন দ্রুততর করে তাদের আর্থিক অবস্থার বিচার না করে উচ্চ মানের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পথনির্দেশক বিদ্যালয় (Pacesetting school) অর্থাৎ নবােদয় বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।

5.7 : ব্যক্তিগত কর্মনিযুক্তির সুযোগ বৃদ্ধি, দক্ষ জনশক্তির চাহিদা ও জোগানের অসামঞ্জস্যতা দূরীকরণ ও উচ্চশিক্ষিতদের জন্য একটি পরিবর্তন (substitute) উপায় নির্ধারণের উদ্দেশ্যে বৃত্তিমুখী শিক্ষা বিষয়ক সুচিন্তিত অভিমত প্রতিফলিত হয়েছে এই শিক্ষানীতিতে।

5.৪ : উচ্চশিক্ষা মানুষকে জটিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক ইত্যাদি মানবাধিকারের সঙ্গে জড়িত অধিক সমস্যাবলির সমাধানে উদ্বুদ্ধ করে।

5.9 : উচ্চশিক্ষা বিষয়ক বিশেষ পরিকাঠামো গঠনের মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় উন্নয়নে সাহায্য করাই। হল এই শিক্ষানীতির অন্যতম লক্ষ্য। 

5.10 : শিক্ষায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং উচ্চশিক্ষার সুযােগ সকলের নিকট পৌছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে এই শিক্ষানীতিতে। 

5.11 : যে-সমস্ত চাকরির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি কোণ প্রয়োজন হয় না সেসব ক্ষেত্রে চাকরি ও ডিগ্রির মধ্যে সম্পর্কের অবসান গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।

5.12 : শিক্ষায় গান্ধীজীর আদর্শ অনুসারে নতুন ধাঁচের গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও বর্ধিত হবে। এ ছাড়া গান্ধিজির বুনিয়াদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে।