সূচনা: রুশ নেতা স্টালিনকে বাদ দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আটলান্টিক সনদের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বিশ্ব ব্যবস্থাকে গড়ে তােলার কথা ঘােষণা করেন। আটলান্টিক সনদের ঘােষণা (১৯১৪ খ্রি., ১৪ আগস্ট)-কে কেন্দ্র করে সােভিয়েত ও পশ্চিমি রাষ্ট্রজোটের পারস্পরিক দূরত্ব বাড়ে, যা পরবর্তীকালে ঠান্ডা লড়াইয়ের পথকে প্রশস্ত করে।

[1] ইরান নিয়ে মতপার্থক্য: পারস্যের তৈলসম্পদ যাতে অক্ষশক্তি‌ হস্তগত করতে না পারে সেই লক্ষ্যে গ্রেট ব্রিটেন, সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং পারস্যের মধ্যে এক ত্রি-পাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি বলে দক্ষিণাঞ্চলে ব্রিটিশ এবং উত্তরাঞ্চলে সােভিয়েত বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ স্বীকার করে নেওয়া হয়। এ ছাড়াও স্থির হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে দুই দেশ পারস্য থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নেবে। পরে পারস্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রুশ হস্তক্ষেপের বিরােধিতা করে পারস্য রাষ্ট্রসংঘে অভিযােগ জানালে দুই (পারস্য রাশিয়া) দেশের মধ্যে রাষ্ট্রসংঘের মধ্যস্থতায় এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় (এপ্রিল, ১৯৪৬ খ্রি.)। স্থির হয় ২৫ বছরের জন্য উত্তর পারস্যের তৈল সম্পদের ওপর রুশ অধিকার স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু ১৯৪৭ খ্রি. নবগঠিত পারস্যের পার্লামেন্ট (মজলিস) এই চুক্তি বাতিল করে দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সাহায্যের বিনিময়ে তার সঙ্গে পারস্য নতুন করে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এই চুক্তির ভিত্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারস্যকে সামরিক ও অসামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ নিয়ে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই রাজনীতির সূচনা হয়।

[2] দ্বিতীয় রণাঙ্গনের প্রশ্নে মতভেদ: দ্বিতীয় রণাঙ্গনের প্রশ্নে রাশিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লে চার্চিল ঘােষণা (১৯৪২ খ্রি., মে) করেন, ১৯৪২-এর আগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বরে ব্রিটেন মহাদেশীয় ভূখণ্ডে (ইউরােপের কোনাে স্থানে) অবতরণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।” কিন্তু ঘােষণার কিছু দিন পরে (১৯৪২ খ্রি., জুলাই) ব্রিটেন ইউরোপে দ্বিতীয় রণাঙ্গনের পরিকল্পনা ত্যাগ করে। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে কায়রাে ও তেহরান বৈঠকে চার্চিল, রুজভেল্ট ও স্টালিন দ্বিতীয় রণাঙ্গন খােলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কোথায় দ্বিতীয় রণাঙ্গন খােলা হবে, তা নিয়ে মতবিরােধ শুরু হয়।

[3] গ্রিস সমস্যা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হিটলারের নেতৃত্বে‌ জার্মান সেনাবাহিনী গ্রিস দখল করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ বাহিনী গ্রিসকে জার্মান-মুক্ত করে (১৯৪৪ খ্রি.)। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে গ্রিসকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মােকাবিলার লক্ষ্যে গ্রেট ব্রিটেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চায়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রম্যান গ্রিসে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য পাঠান। ফলে রাশিয়া এবং পশ্চিমি  শক্তিবর্গের মধ্যে অবিশ্বাস ও পারস্পরিক বিদ্বেষ বেড়ে যায়।

[4] তুরস্ক বিরােধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের শেষার্ধে রাশিয়া তুরস্কের পূর্বদিকে অবস্থিত প্রদেশের ওপর তার দাবি জানায়। কৃয়সাগরের কাছাকাছি সমস্ত দেশের কাছে দাদানালিকা প্রণালী উন্মুক্ত রাখার কথা বলা হয়। এ ছাড়া কৃষ্মসাগরের কাছাকাছি অবস্থিত নয় এমন দেশের ক্ষেত্রে বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া দার্দানালিকা প্রণালীতে যুদ্ধজাহাজ যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য তুরস্কের ওপর সােভিয়েত রাশিয়া চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু তুরস্ক সেই চাপকে অগ্রাহ্য করে আমেরিকার কাছে সাহায্য চায়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি টুম্যান তুরস্কে বিশেষ অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য পাঠালে ঠান্ডা লড়াইয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়।

[5] পটসডাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত: পটল্ডাম সম্মেলনে জার্মানির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ নিয়ে সােভিয়েত ও মার্কিন মতবিরােধ প্রকট হয়ে ওঠে। বলা হয়, পটল্ডাম সম্মেলন থেকেই ঠান্ডা লড়াই প্রকাশ্যে আসে।

[6] সােভিয়েত বিরােধী নীতিসমূহ

  • চার্চিলের ফালটন বক্তিতা: ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল আমেরিকার মিসৌরি প্রদেশের অন্তর্গত ফালটনের ওয়েস্টমিনস্টার কলেজে এক ভাষণে (১৯৪৬ খ্রি., ৫ মার্চ) রুশ আগ্রাসন থেকে ইউরােপীয় সভ্যতাকে রক্ষা করার দায়িত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অর্পণ করেন।

  • কেন্নানের বেষ্টনী তত্ত্ব: রাশিয়ায় কর্মরত প্রাক্তন সহকারী মার্কিন রাষ্ট্রদূত জর্জ এফ. কেন্নান, মি. এক্স ছদ্মনামে আমেরিকার ফরেন অ্যাফেয়ার্স নামে পত্রিকায় এক প্রবন্ধে সােভিয়েতে আক্রমণাত্মক নীতি প্রতিহত করার জন্য এবং সােভিয়েত প্রভাবকে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য ‘বেষ্টনী তত্ত্ব’ (১৯৪৭ খ্রি., ৪ জুলাই) প্রকাশ করেন, যা মার্কিন প্রশাসন মেনে নেয়।

[7] টুম্যান নীতি ও মার্শাল পরিকল্পনা: 

  • [i] আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হ্যারি টুম্যান মার্কিন কংগ্রেসে এক বক্তৃতায় (১৯৪৭ খ্রি., ১২ মার্চ) তুরস্ক ও গ্রিস-সহ বিশ্বের যে-কোনাে দেশকে সােভিয়েত অগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দেন।

  • [ii] ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ জুন আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তিতায় আমেরিকার বিদেশমন্ত্রী জর্জ মার্শাল যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরােপে আর্থিক পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে এক পরিকল্পনা পেশ করেন। ফলে ঠান্ডা লড়াইয়ের ক্রমবিকাশ ঘটে।

উপসংহার: ঠান্ডা লড়াইয়ের ক্রমবিকাশ সার্বিকভাবে বিশ্বজুড়ে এক যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করলেও শেষপর্যন্ত, সোভিয়েত মার্কিন দু-পক্ষের প্রচেষ্টায় কোনাে দেশবাসীকে আর একটি বিশ্বযুদ্ধ দেখতে হয়নি।