সূচনা: ভারত-সচিব মন্টেগু ও ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডের যৌথ রিপাের্টের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে নতুন ভারত শাসন আইন পাস হয়। এটি মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার বা ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন নামে পরিচিত।

[1] ক্ষমতা বণ্টন: মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনের দ্বারা কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ও আয় সুনির্দিষ্টভাবে বণ্টিত হয়।

  • কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা, রেলব্যবস্থা, মুদ্রাব্যবস্থা, বৈদেশিক সম্পর্ক, আয়কর, শুল্ক, বাণিজ্য, ডাকব্যবস্থা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির দায়িত্ব দেওয়া হয়।

  • প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা: প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সেচ, ভূমিরাজস্ব, যােগাযােগব্যবস্থা প্রভৃতি তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির দায়িত্ব দেওয়া হয়।

[2] কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ: মন্টেগু চেমসফোর্ড আইনের দ্বারা ৮ জন সদস্য নিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ বা বড়ােলাটের শাসন পরিষদ (Executive Council) গঠিত হয়। এই ৮ জনের মধ্যে অন্তত ৩ জন সদস্য হবেন ভারতীয়। এই শাসন পরিষদের সহায়তায় বড়ােলাট শাসন পরিচালনার দায়িত্ব পান। বড়ােলাট তার কার্যাবলির জন্য ভারতীয় আইনসভার কাছে নয়, ভারত-সচিব ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী থাকতেন।

[3] কেন্দ্রীয় আইনসভা: ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় আইনসভা গঠন করা হয়। এর বিশেষ দিকগুলি ছিল—

  • দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা: মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনের দ্বারা কেন্দ্রে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। এর নিম্নকক্ষের নাম হয় কেন্দ্রীয় আইনসভা (Legislative Assembly) এবং উচ্চকক্ষের নাম হয় ‘রাষ্ট্রীয় পরিষদ’ (Council of States)।

  • সদস্যসংখ্যা: উচ্চকক্ষের ৬০ জন সদস্যের মধ্যে ২৬ জন ছিলেন বড়লাটের দ্বারা মনােনীত ও ৩৪ জনকে নির্বাচিত এবং নিম্নকক্ষের ১৪০ (পরে ১৪৫) জন সদস্যের মধ্যে ৪০ জনকে মনােনীত এবং ১০০ (পরে ১০৫) জনকে নির্বাচিত করার ব্যবস্থা করা হয়। উভয় কক্ষে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

  • আইন প্রণয়ন: আইনসভার সদস্যরা সভায় কোনাে বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন, বিতর্কে যােগদান, ছাঁটাই বা সংশােধনী প্রস্তাব পেশ প্রভৃতির অধিকার পেলেও বৈদেশিক নীতি, সামরিক বিভাগ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বড়ােলাটের পূর্ব অনুমতি ছাড়া আলােচনার অধিকার পেতেন না। বড়ােলাট আইনসভার যে কোনাে আইন সংশােধন বা বাতিল করতে পারতেন। তিনি নিজেও অর্ডিন্যান্স জারি করে আইন প্রণয়ন করতে পারতেন।

[4] প্রাদেশিক দ্বৈতশাসন: মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনের দ্বারা প্রদেশগুলিতে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। এর ৭০ শতাংশ সদস্য নির্বাচিত ও ৩০ শতাংশ সদস্য গভর্নরের দ্বারা মনােনীত করার ব্যবস্থা হয়। প্রাদেশিক সরকারের দায়িত্বগুলিকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা—

  • সংরক্ষিত বিষয়
  • এবং হস্তান্তরিত বিষয়।

সংরক্ষিত বিষয়গুলি ছিল আইনশৃঙ্খলা, অর্থ, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার, শ্রম প্রভৃতি। প্রাদেশিক গভর্নর ও তাঁর কার্যনির্বাহক সভার ওপর এই বিষয়গুলি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। হস্তান্তরিত বিষয়গুলি ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বায়ত্বশাসন প্রভৃতি। এই বিষয়গুলি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রাদেশিক মন্ত্রীদের হাতে। মন্ত্রীরা তাদের কাজকর্মের জন্য প্রাদেশিক আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকতেন। হস্তান্তরিত বিষয়ে প্রাদেশিক আইনসভার দ্বারা পাস করা কোনাে আইন গভর্নর বা গভর্নর-জেনারেল বাতিল করতে পারতেন। এভাবে এই আইনের মাধ্যমে প্রদেশগুলিতে একদিকে গভর্নরের কার্যনির্বাহক সভা এবং অন্যদিকে প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার দ্বৈত শাসনব্যবস্থা (Dyarchy) চালু হয়।

[5] ভারত সচিবের কাউন্সিল: মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনে বলা হয় যে, ভারত সচিবের কাউন্সিলের সদস্যসংখ্যা ৮ থেকে ১২ জন হবে। এর অর্ধেক সদস্য নিযুক্ত হবেন ভারতে কমপক্ষে ১০ বছর বসবাস বা চাকরি করেছেন এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে। এই সদস্যদের বেতন ও ভাতা প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রিটিশ সরকারের হাতে।

উপসংহার: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ ভারতীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে আরও বেশি সচেতন হয়ে ওঠে। তাই ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের আইন তাদের খুশি করতে পারেনি।