সূচনা: ভারতীয় আইন পরিষদে বেশি সংখ্যায় নির্বাচিত ভারতীয় সদস্য গ্রহণ ও তাদের হাতে বেশি পরিমাণে ক্ষমতা দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসে চরমপন্থী গােষ্ঠীর উত্থান, ক্রমে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের প্রসার, বাংলা, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী আন্দোলন প্রভৃতি ঘটনা সরকারকে যথেষ্ট বিপাকে ফেলে দেয়। এই পরিস্থিতিতে ভারতের জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করা, কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতৃবৃন্দ এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে খুশি করা প্রভৃতি উদ্দেশ্যে ভারত সচিব জন মর্লে এবং বড়ােলাট লর্ড মিন্টো একটি শাসন সংস্কারের পরিকল্পনা করেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে এই শাসন সংস্কার প্রবর্তন করা হয়-যা মর্লে-মিন্টো শাসনতান্ত্রিক সংস্কার আইন বা ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের কাউন্সিল আইন নামে পরিচিত।

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তিত মলে-মিন্টো শাসনতান্ত্রিক সংস্কার আইনের শর্তাবলির দুটি দিক ছিল। যথা—কার্যনির্বাহক পরিষদ এবং আইন পরিষদ।

[1] কার্যনির্বাহক পরিষদ: মর্লে-মিন্টো শাসনতান্ত্রিক সংস্কার আইনে কেন্দ্রে এবং বিভিন্ন প্রদেশে কার্যনির্বাহক পরিষদ গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

  • কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ: এই আইন অনুসারে কেন্দ্রে বড়ােলাটের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদে একজন করে ভারতীয় প্রতিনিধি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই হিসেবে প্রথম ভারতীয় সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহ।

  • প্রাদেশিক কার্য নির্বাহক পরিষদ: মর্লে-মিন্টো শাসনতান্ত্রিক সংস্কার আইন অনুসারে প্রতিটি প্রাদেশিক পরিষদেও একজন করে ভারতীয় প্রতিনিধি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে বাংলা, বােম্বাই, মাদ্রাজ প্রভৃতি প্রদেশের গভর্নরের কার্যনির্বাহক পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১ থেকে বাড়িয়ে ৪ জন করা হয়। কিন্তু বিষয়টি বাধ্যতামূলক ছিল না। রাজা কিশােরীলাল গােস্বামীকে বাংলার কার্যনির্বাহক পরিষদের সদস্য হিসেবে নিয়ােগ করা হয়।

[2] আইন পরিষদ: মর্লে মিন্টো আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের গঠন ও ক্ষমতার বিষয়ে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

  • কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ: কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১৬ থেকে বাড়িয়ে ৬০ জন করা হয়। এই আইন পরিষদ বাজেট তৈরি, বাজেট পাস, বাজেট সম্পর্কে আলােচনা, ভােটদানের অধিকার এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা ও সুপারিশ করার ক্ষমতা পায়। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে মুসলিম সম্প্রদায়কে আলাদাভাবে সদস্য নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়।

  • প্রাদেশিক আইন পরিষদ: প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলির সদস্য সংখ্যা ৩০ থেকে ৫০-এর মধ্যে রাখা এবং নির্বাচিত সদস্য সংখ্যার তুলনায় মনােনীত সদস্যদের সংখ্যা সর্বদা বেশি থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই পরিষদগুলিও বাজেট তৈরি, বাজেট পাস, বাজেট সম্পর্কে আলােচনা ও ভােটদানের অধিকার পায়। গভর্নর- জেনারেল ও প্রাদেশিক গভর্নরগণ তাদের অপছন্দের যে-কোনাে সদস্যকে আইন পরিষদ থেকে অপসারণের অধিকার পান।

[1] বড়ােলাটের চূড়ান্ত ক্ষমতা: মর্লে-মিন্টো আইনের মাধ্যমে বড়ােলাটের আইনসভার হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছিল। এই আইনের দ্বারা বড়ােলাট আইনসভার যে-কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সংশােধন বা বাতিল করার অধিকারী ছিলেন। বড়ােলাট নিজের পছন্দে আইনসভার বেসরকারি সদস্যদের মনােনীত করতেন এবং তারা বড়ােলাটের ইচ্ছানুসারে কাজ করতেন। এর ফলে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে সরকারি ও মনােনীত সদস্যরা মিলে আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশে পরিণত হন। এভাবে প্রকৃতপক্ষে বড়লাটের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়।

[2] ভােটাধিকার: মর্লে-মিন্টো আইনের দ্বারা ভারতীয়দের সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার স্বীকৃত হয়নি। এর দ্বারা মুষ্টিমেয় ভারতীয়কে ভােটাধিকার দেওয়া হয়। তা ছাড়া নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কোনাে ক্ষমতা বা তাদের মতামতের কোনাে গুরুত্ব ছিল না। তাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যানের সম্পূর্ণ ক্ষমতা ছিল সরকারের হাতে।

[3] অধিকারহীনতা: এই আইনের মাধ্যমে দেশীয় রাজ্য, সামরিক বিভাগ, বিদেশনীতি প্রভৃতি বিষয়ে কোনাে প্রস্তাব আনার অধিকার আইনসভার হাতে ছিল না।

[4] দায়িত্বশীলতার অভাব: মর্লে-মিন্টো আইনের দ্বারা কেন্দ্রে এবং প্রদেশে নির্বাচিত ভারতীয় জনপ্রতিনিধিদের বিশেষ কোনাে গুরুত্ব স্বীকৃত হয়নি। ফলে এই আইন ভারতে কোনাে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।

[5] সাম্প্রদায়িক নির্বাচন: মরলে-মিন্টো আইন দ্বারা সরকার মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সাম্প্রদায়িকতাকে ইন্ধন দেয়। ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার এই আইনকে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রথম সরকারি উদ্যোগ বলে অভিহিত করেছেন।

[6] কংগ্রেসের ক্ষোভ: মর্লে-মিন্টো আইন কংগ্রেসের চরমপন্থী ও নরমপন্থী উভয় গােষ্ঠীকেই অসন্তুষ্ট করে। এই আইন চরমপন্থী অংশকে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নিলে চরমপন্থীরা ক্ষুদ্ধ হয়। অন্যদিকে নরমপন্থীদের দাবিদাওয়াও এই আইনের দ্বারা পূরণ করা হয়নি।