[1] ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের আইনের ত্রূটি: ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভায় মাত্র তিনজন মনােনীত সদস্যকে গ্রহণ করা হয়। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনে সরকারের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদে বেসরকারি সদস্য হিসেবে ভারতীয়দের সংখ্যা বাড়ানাে হয়। কিন্তু এই নামমাত্র সংস্কারে ভারতীয়রা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র এসব আইনের মাধ্যমে ভারতীয়দের হাতে অধিকার দানের ঘটনাকে ‘একটি ধাপ্পাবাজি’ বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয়রা ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের আইনে সন্তুষ্ট না হয়ে তাদের হাতে বেশি ক্ষমতা প্রদান এবং শাসনকার্যে আরও বেশি অংশগ্রহণের সুযােগ দেওয়ার দাবি জানাতে থাকে।

[2] কংগ্রেসের প্রতিবাদ: জাতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার অন্যতম বিষয় ছিল ভারতীয় আইন পরিষদে বেশি সংখ্যক নির্বাচিত ভারতীয় সদস্য গ্রহণ করা এবং তাদের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা প্রদান করা। এসব দাবিতে জাতীয় কংগ্রেস ভারতের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সােচ্চার হয়। পূর্বতন আইনগুলির মাধ্যমে যেহেতু আইন পরিষদে বেশি সংখ্যক নির্বাচিত ভারতীয় সদস্য গ্রহণের সুযােগ ছিল না, সেহেতু সরকার নতুন আইন প্রণয়নের কথা ভাবতে থাকে।

[3] বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলন: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে দেশব্যাপী বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী স্বদেশি আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার সমস্যার সম্মুখীন হয়। বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসে চরমপন্থী গােষ্ঠীর উত্থান ঘটলে আন্দোলনের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে সরকার বিপাকে পড়ে যায়।

[4] বিপ্লবী আন্দোলন: বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলনের একটি ধারা ক্রমে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদের পথ ধরে। বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত আন্দোলনের ফলে সরকার আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিপ্লবী আন্দোলন বাংলা, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। সরকার এসব আন্দোলন দুর্বল করার কথা ভাবতে শুরু করে।

[5] মুসলিম লিগের দাবি: ঢাকায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে লিগের নেতৃবৃন্দ মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবিতে সােচ্চার হয়। এ বিষয়ে তারা সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবিদাওয়া জানায়। মুসলিম সম্প্রদায়কে খুশি করার কথা সরকার ভাবতে শুরু করে।

[1] বড়ােলাটের একাধিপত্য: মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনের মাধ্যমে বড়ােলাট ও তার কার্যনির্বাহক সভার হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। তিনি আইনসভার যে-কোনাে প্রস্তাব নাকচ করতে পারতেন। এই আইনে ভারতে কোনাে প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়নি।

[2] দায়িত্বশীলতার অভাব: এই আইন অনুসারে, বড়ােলাট তাঁর কাজের জন্য ভারতীয় আইনসভার কাছে দায়ী ছিলেন না। তিনি দায়ী ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও ভারত সচিবের কাছে। ফলে এই আইনের দ্বারা ভারতে কোনাে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

[3] স্বায়ত্তশাসনের অভাব: এই আইনে প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। কেননা, প্রদেশে গভর্নর ছিলেন চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তিনি তার মন্ত্রীসভার যে-কোনাে সিদ্ধান্ত নাকচ করতে পারতেন।

[4] আইনসভার ক্ষমতাস: এই আইনের দ্বারা কেন্দ্রে গভর্নর-জেনারেল এবং প্রদেশে গভর্নরের চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে কেন্দ্র ও প্রদেশের নির্বাচিত আইনসভা কার্যত ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে।

[5] ভােটাধিকার: মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইনে সর্বসাধারণের ভােটাধিকার স্বীকৃত হয়নি। এর দ্বারা স্বল্প সংখ্যক ধনী ব্যক্তি ভােটাধিকার পান যা ছিল ভারতের মােট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ।

[6] সাম্প্রদায়িকতা: এই আইনের দ্বারা ভারতে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ আরও বৃদ্ধি করা হয়। মুসলিমদের পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য পৃথক নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এজন্য জাতীয় কংগ্রেসের বােম্বাই অধিবেশনে এই আইনকে ‘তুচ্ছ, বিরক্তিকর ও নৈরাশ্যজনক’ বলে সমালােচনা করা হয়। শ্রীমতী অ্যানি বেসান্ত একে ‘দাসত্বের পরিকল্পনা’ এবং তিলক ‘সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযােগ্য’ বলে অভিহিত করেন।