উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাঙলায় যে ‘রেনেসাঁস’ বা ‘নবজাগরণ’ দেখা দিয়েছিল, তার প্রধান ফলশ্রুতি ছিল মানস-মুক্তি। অতএব অত্যন্ত স্বাভাবিক এবং সঙ্গত কারণেই সমকালীন লেখকদের মনেও দেশপ্রেম এবং স্বাদেশিক মনােভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। তাই সেকালের সাহিত্যে, এমন কি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এবং রঙ্গলালের কাব্য দেশাত্মবােধের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে কাব্যে স্বাদেশিকতার যতটা পরিচয় লভ্য, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় নাটকে কারণ এতে শুধু বর্ণনাই নয়, ঘটনাপুঞ্জ এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েও একে প্রকাশ করা যায়।
দেশাত্মবােধের যে আগুন তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালীর মনে ধিকিধিকি জ্বলছিল, ১৯০৫ খ্রীঃ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তাকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে সাহায্য করলাে। এতােদিন যা’ ছিল আগ্নেয়গিরির মতাে সুপ্ত, এবার তাতে অগ্নি-উদগীরণ লক্ষ্য করা গেলাে। বিশেষতঃ এ সময় থেকে যত ঐতিহাসিক নাটক বাঙলা ভাষায় রচিত হয়েছে তাদের অধিকাংশই দেশাত্মবােধের প্রেরণায় সৃষ্টি। শুধু ১৯০৫ সালের পরবর্তী কেন, তার পূর্ববর্তী অনেক নাটকেও দেশাত্মবােধের পরিচয় পাওয়া যায়। যথা মাইকেল মধুসূদন-রচিত ‘কৃষ্ণকুমারী নাটক’ (১৮৬১), দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ নাটক’ (১৮৬০), উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘শরৎসরােজিনী’ (১৮৭৪) ও ‘সুরেন্দ্র-বিনােদিনী’ (১৮৭৫), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পুরুবিক্রম’ (১৮৭৫) ও ‘অশুমতী’, কিরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত দু’খানি ক্ষুদ্র নাটিকা ‘ভারতমাতা’ (১৮৭৩) নামক একখানি রূপক বা ‘মাস্ক’ এবং ‘ভারত যবন’ (১৮৭৪) ও হরলাল রায়ের ‘হেমলতা’ (১৮৭৩) ও ‘বঙ্গের সুখাবসান’ (১৮৭৪-৭৫)। এ ছাড়াও কিছু নাট্যকার যাঁরা বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেন, তাদের কোন কোন নাটকেও দেশাত্মবােধের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য দক্ষিণারঞ্জন চট্টোপাধ্যায়-রচিত ‘চা-কর দর্পণ’- এর কথা; এই নাটকটিকে অজুহাত-রূপে গ্রহণ করেই তৎকালীন ইংরেজ সরকার ১৮৭৬ খ্রীঃ ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ (Dramatic Performances Control Act) প্রণয়ন করে নাটকের অভিনয় ব্যাপারে নানাপ্রকার বাধা-নিষেধ আরােপ করেন।
পূর্বোক্ত নাটকগুলিতে যে দেশাত্মবােধের পরিচয় পাওয়া যায়, তা যেন অনেকটা প্রসঙ্গক্রমে এসে গেছে। কিন্তু ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে দেশময় যে ব্যাপক স্বাদেশিকতাবােধের সৃষ্টি হয়েছিল, তারই প্রত্যক্ষ প্রভাবে বেশ কিছু নাট্যকার উদ্দেশমূল কভাবেই কিছু ঐতিহাসিক নাটকে দেশপ্রেমের জয়গান রচনা করে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন। এদের মধ্যে বিশেষভাবেই উল্লেখযােগ্য হলাে বাঙলা নাটকের প্রাণপুরুষ গিরিশচন্দ্র ঘােষের প্রচেষ্টা। অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য বলেন, এই সময়, ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড কার্জনের নির্দেশে বঙ্গদেশ দ্বিখণ্ডিত হলে সারা দেশে তার বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ ঘনিয়ে ওঠে। বস্তুতঃ “এই বঙ্গভঙ্গকে অবলম্বন করেই বাঙলায় প্রথম গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে, ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে এবং দেশবাসী স্বাধীনতা লাভের মন্ত্রে দীক্ষা লাভ করে। পাদপ্রদীপের আলােয় উদ্ভাসিত রঙ্গমঞ্চে অধিষ্ঠিত গিরিশচন্দ্র অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহেও জনগণের নাড়ীর স্পন্দন অনুভব করতে পারতেন, অতএব স্বাদেশিকতার উদ্বোধন-লগ্নে তিনি দেশবাসীকে উপহার দিলেন রাজনৈতিক চেতনা সম্পৃক্ত ঐতিহাসিক নাটক ‘সিরাজউদ্দৌলা’ (১৯০৬)।” কিন্তু সন্ধ্যায় প্রদীপ-জ্বালানাের আগেই সলতে পাকানাে। হয়েছিল তার অব্যবহিত পূর্বেই। ক্ষীরােদপ্রসাদ বিদ্যাবিনােদ ১৯০৩ শ্ত্ষ্টাব্দে ‘বঙ্গের প্রতাপাদিত্য’, গিরিশচন্দ্র স্বয়ং ১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে ‘সৎনাম’ বা ‘বৈষ্ণবী’ এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘প্রতাপসিংহ’ নামক ঐতিহাসিক নাটকেই দেশপ্রীতির পরিচয়-চিহ্ন মুদ্রিত করে গেছেন।
গিরিশচন্দ্র ঘােষ দেশপ্রেমে উদ্দীপিত হয়েই বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে পরপর তিনখানি নাটক রচনা করেন— ‘সিরাজউদ্দৌলা’ (১৯০৬), ‘মীরকাশিম’ (১৯০৬) এবং ‘ছত্রপতি শিবাজী’ (১৯০৭)। এই তিনটিতেই লেখক প্রখর ইতিহাসবােধের পরিচয় দিলেও এর প্রভাবে নাটকীয়তা অনেকাংশে ক্ষুগ্ন হয়েছিল। “এই ঐতিহাসিক নাটকগুলিতে গিরিশচন্দ্র যে সমকালীন বাঙালীর রাজনৈতিক চেতনা ও স্বাদেশিকতাবােধের প্রচণ্ড জ্বালার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন, তার প্রমাণ-ইংরেজ সরকার ১৯১১ খ্রীষ্টাব্দে গিরিশচন্দ্রের এই নাটকত্রয়ের অভিনয় নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন।”
গিরিশচন্দ্রের সামসাময়িক অমৃতলাল বসুর বিভিন্ন সামাজিক নাটক ও প্রহসনে সমাজ সংস্কারমূলক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে দেশহিতৈষণার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে স্বদেশী আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে রচিত ‘সাবাস বাঙ্গালী’ (১৯০৬) নাটকে স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণ ও বিদেশী বর্জনের আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে। ১৮৭৫ খ্রীঃ প্রকাশিত তাঁর রাজনৈতিক নাটক ‘হীরকচূর্ণ নাটকে’ ও দ্বিধাহীনচিত্তে ইংরেজ শাসনের সমালােচনা করেন।
বিংশ শতকের প্রথম পাদে আবির্ভূত নাট্যকারদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ক্ষীরােদপ্রসাদ বিদ্যাবিনােদ। ১৯০৩ খ্রীঃ রচিত তাঁর ‘বঙ্গের প্রতাপাদিত্য’ নাটকের কথা আগেই বলা হয়েছে। এ ছাড়া তিনি অপর যে সকল ঐতিহাসিক নাটক রচনা করেছেন, তাদের প্রায় সবগুলিতেই স্বাদেশিক মনােভাবের সুস্পষ্ট প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য—‘পদ্মিনী’ (১৯০৬), ‘চাদবিবি’ (১৯০৭), ‘পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত’ (১৯০৭), ‘নন্দকুমার’ (১৯০৮), ‘বাঙ্গলার মসনদ’ (১৯১০), ‘আলমগীর’ (১৯২১) প্রভৃতি। যে সমস্ত নাটকে ইংরেজ শাসনের কথা আছে, অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইনে’র ভয়ে সে সমস্ত ক্ষেত্রে সরাসরি ইংরেজ-বিদ্বেষ প্রচার করা সম্ভবপর না হলেও দেশপ্রীতি প্রকাশে কোথাও কোন অসুবিধার সৃষ্টি হয় নি। ক্ষীরােদপ্রসাদের একটি রঙ্গনাটিকা ‘দাদা ও দিদি’ ১৯০৮ খ্রীঃ দেশপ্রেমের তপ্ত ভূমিকায় রচিত। এতে নাট্যকার অতীব কৌশলে ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শােষণ ব্যবস্থাকে আক্রমণ করে স্বাদেশিকতাবােধের পরিচয় দিয়েছেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৯০৩ খ্রীঃ ঐতিহাসিক নাটক রচনা করলেও বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কালে সমগ্র দেশ যখন দেশাত্মবােধে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, তৎকালে রচিত ‘প্রতাপসিংহ’ (১৯০৫) নাটকেই জাতির মর্মবেদনার সঙ্গে নাটকের ভাবকে সমন্বিত করেন। পরবর্তী ‘দুর্গাদাস’ (১৯০৬) নাটকে তেমন উজ্জ্বলভাবে না হলেও স্বাদেশিকতা-বােধের অভাব ছিল না। মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে রাজপুত জাতির যে সংগ্রাম-কাহিনী ‘মেবার-পতন’ (১৯০৮) নাটকে প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল স্বদেশবাসীর চৈতন্য-বােধকেই জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর ‘সাজাহান’ (১৯০৯) নাটকে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও কোন কোন রাজপুত নায়কের কথােপকথনে সমমনােভাবই প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলা ভাষায় রচিত ঐতিহাসিক নাটকগুলি বিশ্লেষণ করলে প্রায় সর্বত্রই একটা উদ্দেশ্যমূলকতা নজরে আসে—সেটা এই দেশাত্মবােধের প্রচার, কোথাও উগ্রভাবে, কোথাও বা অলক্ষ্যে। এই স্বাদেশিকতাবােধকে বিভিন্ন নাট্যকার বিভিন্নভাবে প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন। জনৈক গবেষকের ভাষায় বলা চলে, “দীনবন্ধু মিত্রের সর্বব্যাপী সহানুভূতি ও সৃগভীর সামাজিক অভিজ্ঞতায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জাতীয় হিতবাদী ঐতিহাসিক চেতনায়, গিরিশচন্দ্র ঘােষের ভক্তিরসাশ্রিত মানবপ্রেম ও স্বদেশ মহিমায়, ক্ষীরােদপ্রসাদ বিদ্যাবিনােদের পৌরাণিক শক্তির সাধনাশ্রিত দেশাত্মবােধ প্রচারে এবং দ্বিজেন্দ্রলালের বিশ্বপ্রেমরূপ মানবতাবাদে জাতির বন্ধনমুক্তির বাসনা সমানভাবে উচ্চারিত।”
Leave a comment